• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

বিপর্যয়ের শঙ্কা পশুর চামড়া কেনাবেচায়

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৯ জুলাই ২০২১

কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে এবারো বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যদিও চামড়া পাচারে বন্ধে আগ থেকেই সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে চামড়া পাচার সিন্ডিকেট। তারা মোটা অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করে মৌসুমি বিক্রেতাদের জিম্মি করে কম দামে কাঁচা চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব চামড়ার বড় একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারের ফন্দি এঁটেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া কিনে ওই চক্রটি বিদেশে পাচার করে দেয়। কারণ দেশের ট্যানারি ব্যবসায়ীদের নানা অনিয়মের কারণে মাঠপর্যায়ের চামড়া সংগ্রহকারী অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। এজন্য গত কয়েক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে মৌসুমি বিক্রেতাদের চামড়া কেনার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, চামড়া বাজারে অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে বিক্রেতাদের অনেকেই ৩০ শতাংশ কম মূল্যে পশুর চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ২০১৯ সালেও কোরবানির পশুর চামড়া বাজারে বড় বিপর্যয় দেখা দেয়। এতে পুঁজি হারান অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী। ফলে ট্যানারি মালিকসহ এ শিল্পসংশ্লিষ্টরা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও মৌসুমি ব্যবসায়ী ব্যবসায়ীরা ক্ষত্রিগ্রস্ত  হয়েছিলেন। একই সঙ্গে দেশের গরিব, এতিম ও অসহায় মানুষ তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর গত বছর করোনা মহামারীর মধ্যে উদযাপিত হয় ঈদুল আজহা। ওই ঈদে রাজধানীতে গরুর চামড়া প্রতিটি ১৫০ থেকে ৫০০ টাকা ও ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ২ থেকে ১০ টাকায়। স্মরণকালের এই বিপর্যয়ের কথা এখনো কেউ ভোলেনি। এরই মধ্যে চলে আসছে আরো একটি ঈদ। তবে এবারের ঈদে চামড়ার বাজার পর্যবেক্ষণে যৌথ সমন্বয়ক কমিটি, জাতীয় ও বিভাগীয় মনিটরিং টিম এবং কন্ট্রোল সেল গঠন করেছে সরকার। তবুও বার বার পুঁজি হারিয়ে বিপর্যস্ত মৌসুমি চামড়া ক্রেতাদের আগ্রহ নেই কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের।

জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারতে পাচারের কারনে পুঁজি হারানোর শঙ্কায় সীমান্তবর্তী জেলায় নেই চামড়া কেনার প্রস্তুতি। তা ছাড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়ে থাকায় আসন্ন কোরবানির ঈদে চামড়া কেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জয়পুরহাট জেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা। যদিও প্রতিবছর কোরবানির ঈদে জয়পুরহাটের আড়তগুলো থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকার পশুর চামড়া ঢাকায় সরবরাহ করা হয়। তারপরও এ বছর জেলার চামড়ার আড়তগুলোতে নেই কোনো প্রস্তুতি। ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার পাশাপাশি বাজার এমনিতেই লোকসানে, তার ওপর ট্যানারি মালিকদের কোটি-কোটি টাকার বাকি দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক চামড়া ব্যবসায়ী।

রংপুর প্রতিনিধি জানায়, এবার কোরাবানির পশুর চামড়া কেনার আগ্রহ নেই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। জেলায় চামড়া কেনা-বেচার জন্য হাজীপাড়া চামড়াপট্টি বিখ্যাত। প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করেন এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতারা। তবে এ বছর চামড়া কেনার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের তেমন আগ্রহ নেই। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী গুদাম বন্ধ করে রেখেছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, চামড়া শিল্পে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় হাতে গোনা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে পশুর চামড়া ন্যায্য দামে বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে দিন দিন চামড়াবিমুখ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে অনেকেই গড়ে তুলেছেন অটোবাইক ও রিকশার দোকান। তাই আসন্ন ঈদুল আজহার কোরবানির পশুর চামড়া কেনাকে সামনে রেখে পোস্তায় তেমন কোনো কর্মচাঞ্চল্য নেই। প্রায় ১০-১২ জন ফড়িয়া এবং হাতেগোনা ৩-৪ জন ব্যবসায়ী চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিয়েছেন।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ দর গত বছরের চেয়ে বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত চামড়ার দাম নির্ধারণ নিয়ে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বছর রাজধানীর জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কাঁচা চামড়ার সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা সার্বক্ষণিক তদারকি করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৪ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সেল গঠনের পাশাপাশি ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় যৌথ সমন্বয় কমিটি এবং ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিভাগীয় মনিটরিং কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, লবণযুক্ত চামড়া সংরক্ষণ, পরিবহন এবং ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সব বিষয় তদারকির জন্য প্রতিটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করবে মন্ত্রণালয়।

এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মালেকা খায়রুন্নেছাকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি সার্বক্ষণিকভাবে, লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ, পরিবহন ও ক্রয়-বিক্রয়ে উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে জেলা/উপজেলা কন্ট্রোল সেল থেকে প্রাপ্ত সমস্যা লিপিবদ্ধকরণ এবং তা নিরসনে কার্যক্রম গ্রহণ করা, জটিল ও নীতিগত বিষয় সমাধানের লক্ষ্যে প্রাপ্ত সমস্যাবলি মন্ত্রণালয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় সমন্বয় ও মনিটরিং কমিটির নিকট তাৎক্ষণিক সরবরাহ করবেন।

এদিকে কাঁচা চামড়ার সংরক্ষণ, ক্রয়/বিক্রয় ও পরিবহনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা সার্বক্ষণিক তদারকি করার লক্ষ্যে বিভাগওয়ারী সমন্বয়ের লক্ষে অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানকে প্রধান করে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি যৌথ কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর,  রাজশাহী ও ময়মনসিংহের চামড়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কর্মকর্তাদের দুজন করে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এই কমিটি কাঁচা চামড়ার সংরক্ষণ ও ক্রয়/বিক্রয়সহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে সমন্বয়, চামড়ায় লাগানোর জন্য ব্যবহূত লবণের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয় ওবিক্রয় মনিটরিং, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত সকল মনিটরিং টিমের (বিভাগীয়, জেলা পর্যায়ে) কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, অনান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় কর্তৃপক্ষের নজরে এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, কেন্দ্রীয় যৌথ সমন্বয় কমিটির সঙ্গে সার্বিক বিষয় সমন্বয় করবেন। এই কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবেন।

অন্যদিকে, কাঁচা চামড়ার সংরক্ষণ, ক্রয়/বিক্রয় ও পরিবহনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা সার্বক্ষণিক তদারকি করতে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় যৌথ সমম্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান সমন্বয়ক করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষকে। এ ছাড়া এই কমিটিতে সদস্য থাকছেন-এফবিসিসি সভাপতি, আইনিবন্ধক (অতিরিক্ত সচিব), যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর সদস্য (বানী), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন প্রতিনিধি, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, সভাপতি, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সভাপতি, বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চামড়া অন্যতম জাতীয় সম্পদ ও রপ্তানি পণ্য। এই খাতের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে চামড়াশিল্পকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ও ফুটওয়্যার, প্লাস্টিকসামগ্রী এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের রপ্তানি বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এক্সপোর্ট কমপেটেটিবনেস ফর জবস (ইসিফোরজে) শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ছয় বছরমেয়াদি এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৯৪১ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের চামড়াশিল্পকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়ার জন্যও কাজ চলছে।

কোরবানির পশুর চামড়া আহরণ, সংরক্ষণ পরিবহন এবং ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত সাপ্লাই চেইনে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সারা দেশের প্রশাসন কাজ করছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads