• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে ডেল্টা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে ডেল্টা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০২১

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। সংক্রমণের প্রায় দেড় বছর পর বাংলাদেশে চলতি মাসেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে কোভিড-১৯। এ মাসেই সংক্রমণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা। গত চার দিনে করোনায় মারে গেছে ৮৩৬ জন। এর মধ্যে গতকাল সোমবার মৃত্যু হয়েছে ২৪৭ জনের।

অন্যদিকে গত চার দিনে নতুন শনাক্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৪৬৩ জন। এর মধ্যে গতকাল শনাক্ত হয়েছে ১৫ হাজার ১৯২ জন। শনাক্ত ও মৃত্যুতে এটাই নতুন রেকর্ড।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। ঈদুল আজহায় বিধিনিষেধ শিথিল করায় করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রবলভাবে সক্রিয় হয়েছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এ অবস্থায় আগামী আগস্ট মাসে ডেল্টা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলদের দাবি, করোনার বর্তমান পরিস্থিতি এখনো তাদের আয়ত্তের মধ্যে আছে। কিন্তু পরে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে থাকবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

এদিকে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ২৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৯ হাজার ৫২১ জনে। একই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন আরো ১৫ হাজার ১৯২ জন। এ নিয়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৮২৭ জনে। গতকাল সোমবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এর আগে রোববার ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ২২৮ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সময়ে নতুন ১১ হাজার ২৯১ জন রোগী শনাক্ত হয়। শনিবার ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৯৫ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সময়ে নতুন ৬ হাজার ৭৮০ জন রোগী শনাক্ত হয় এবং শনিবার ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৬৬ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সময়ে নতুন ৬ হাজার ৩৬৪ জন রোগী শনাক্ত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটি আসলে তিন সপ্তাহ আগের অবস্থার বর্তমান পরিণতি। লকডাউন শুরুর হওয়ার আগে সপ্তাহখানেক ধরে প্রায় কোটি মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে গেছে, আবার গ্রাম থেকে শহরের দিকে আসবে, তার প্রভাব কী হতে পারে সেটি দেখার জন্য আগস্ট মাস অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশে করোনা প্রথম শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর ভাইরাসটিতে একজনের মৃত্যুর তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলতি বছরের মার্চ থেকেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে রাখতে ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধসহ লকডাউন ঘোষণা করে সরকার, যা মাঝেমধ্যে কিছুটা শিথিল করা হয়।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের বিরোধিতার পরও করোনার ভয়াবহতার মধ্যেই ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল সরকার। ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের কঠোর বিধিনিষেধও দেওয়া হয়েছে। তবে বিধিনিষেধ শিথিলে কোরবানির পশুর হাট, শপিংমল, মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি মোটেই মানা হয়নি। অনেকেই ঢাকা থেকে বাস, ট্রাক, লঞ্চে গাদাগাদি করে ঈদ করতে গেছেন গ্রামে। ঈদ শেষে ২৩ জুলাই ঢাকায় ফিরেছেনও তারা। এমনকি কঠোর বিধিনিষেধের চতুর্থ দিন সোমবারও ঢাকায় ফিরেছে অনেকে। ফেরি, বাসে ছিল না স্বাস্থ্যবিধির বালাই। গণমাধ্যমের খবর বলছে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজারের নৌরুটে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে এখনো পদ্মা পার হচ্ছে মানুষ। বিআইডব্লিউটিসির এজিএম সফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। রবি ও সোমবার সকাল থেকে ছয়টি ফেরিতে মানুষ গাদাগাদি করে ঢাকা যাচ্ছেন। সবমিলিয়ে ঈদের পর এবার করোনা সংক্রমণ কোথায় ঠেকবে এবং সে পরিস্থিতি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটুকু সামাল দিতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা নিয়ে সরকারের সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। প্রথমটি, চলমান লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা। দ্বিতীয়টি, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। দুই চ্যালেঞ্জের একটিও এখন পর্যন্ত সফলভাবে করা সম্ভব হয়নি। ২৩ জুলাই থেকে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেটি এখন পর্যন্ত কার্যকর বলা যায়। এটি কার্যকর করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে, যা নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা আমাদের দেশের নেই।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ৫০ ভাগ বলা হলেও বাস্তবে মোট আক্রান্তের ৭০ ভাগ এখন গ্রামে। শুরুতে ঢাকা হটস্পট হলেও এখন প্রতিটি জেলা উপজেলাই হটস্পট। সীমান্তে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আটকাতে না পারায় এই পরিস্থিতি হয়েছে। গ্রামে অনেক রোগীর তথ্য আমাদের কাছে নেই। তারা হাসপাতালেও যাচ্ছেন না। টেস্টও করাচ্ছেন না। সর্দি কাশি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাই এবারের লকডাউনের উদ্দেশ্য হলো ঢাকায় যেন গ্রামের মানুষ আসতে না পারে। তবে তার ফল বুঝতে আরো সাত থেকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে।  সংক্রমণ কমবে এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সেটা শতকরা পাঁচ ভাগের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আর সেটা করতে হলে লকডাউন আরো অব্যাহত রাখতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, আগামী মাস অর্থাৎ আগস্টে বড় একটা ধাক্কা আসবে। হাসপাতালের সক্ষমতা কমে আসছে দ্রুত। নির্ধারিত বেডের চেয়ে রোগী বেশি হলে সামলানো যাবে না।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, পরিস্থিতি এখন খুবই উদ্বেগজনক। এর মধ্যে ঈদের জন্য যে ৭-৯ দিন শিথিল হলো, এর জন্য সংক্রমণ আরো বাড়বে। দুই সপ্তাহের (১-১৪ জুলাই) যে লকডাউন দেওয়া হয়েছিল, তাতে সংক্রমণ যে হারে বাড়ছিল ২৫, ৩০ ও ৩৫ শতাংশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল, সেটা থামানো গেছে। গত কয়েক দিন শনাক্ত হার ২৯-৩০ শতাংশের মধ্যে ছিল। ওই লকডাউনের কারণে সংক্রমণ একটা স্থিতিশীল জায়গায় এসেছিল। ঈদের জন্য সবকিছু শিথিল না করলে, সেখান থেকে সংক্রমণ কমত। কিন্তু শিথিলের কারণে এত মানুষ বাইরে গেল, চলাফেরা করল, গ্রামে গেল, সেটার কারণে আগামী সপ্তাহখানেকের ভেতর সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে বাড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, আমরা তো এই পরিস্থিতিটা এড়ানোর জন্য চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা আয়ত্তে রেখেছি। পরের খবর কী হবে সেটা তো বলতে পারছি না। সবাই তো জানেন আমরা কী অবস্থার মধ্যে দিন পার করেছি। আমরা তো স্বাস্থ্যবিধির কোনো কিছুই মানিনি। যেসব বিধিনিষেধ করা হয়েছে তার কোনোটাই মানা হয়নি। মানা হয়নি বললে ঠিক হবে না, সঠিকভাবে আমরা মানতে পারিনি। তবে করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads