• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

গর্ভে মারা যাচ্ছে সন্তান

করোনায় বাড়ছে নারীর মৃত্যু

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ জুলাই ২০২১

সানিয়া আক্তার (২৯)। পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট। স্বামী কে এইচ এম ইমরানুর রহমানও ম্যাজিস্ট্রেট। দুজনেই ঝালকাঠিতে কর্মরত। সানিয়া আক্তারের পেটে সাত মাসের সন্তান। গত ১২ জুলাই পরীক্ষা করালে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই করোনা পজিটিভ আসে। স্বামীর শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলেও করোনাভাইরাস দুর্বল করে ফেলে সানিয়া আক্তারকে। প্রথমে তাকে ঝালকাঠী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ১৬ জুলাই রাতে নিয়ে যাওয়া হয় শেরেবাংলা মেডিকোল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বুধবার সকালে সানিয়ার মৃত্যু হয়।

শুধু সানিয়া নন; দেশে করোনা শুরুর পর এ পর্যন্ত ৬৩৮৯ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে। করোনা শুরুর দিকে নারীর মৃত্যুর হার কম থাকলেও চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বাড়ছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত নারীর মৃত্যুর হার ছিল ২৩ শতাংশ। এপ্রিলে আগ পর্যন্ত ২৪ শতাংশে ছিল। এপ্রিলে শেষে গিয়ে  ২৭ শতাংশে উঠে যায়। মে মাসেও ২৭ শতাংশেই থাকে। জুনে ২৮ শতাংশে ওঠে। আর জুলাইতে প্রায় ৩২ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

শুধু নারীই মারা যাচ্ছে না তা নয়; অনেকের গর্ভে সন্তান মারা যাচ্ছে, মৃত সন্তান প্রসব করছেন। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার সাইনবোর্ড বাজারে সাইনবোর্ড ক্লিনিকের পরিচালক তুহিন মাহমুদ শরীফ বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে তারা অন্তত ১০ জন রোগী পেয়েছেন। যাদের পেটেই সন্তান মারা গেছে।’ তিনি বলেন, এটা নজিরবিহীন। এর আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতা তাদের নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮০৫ জন নারীর মৃত্যু হয়। অর্থাৎ ২৩.৮৮ শতাংশ। পুরুষ মারা যায় ৫৭৫৪ জন। অর্থাৎ ৭৬.১২ শতাংশ। ৩১ ডিসেম্বর ২৮ জন মারা যায়। এরমধ্যে ৭ জন নারী, ২১ জন পুরুষ। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ২২৩৪ জন নারীর মৃত্যু হয়। অর্থাৎ ২৪.৭০ শতাংশ। পুরুষ মারা যায় ৬৮১২ জন। অর্থাৎ ৭৫.৩০ শতাংশ। ৩১ মার্চ ৫২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৩৮ জন পুরুষ, ১৪ জন নারী।

৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মারা যান ৩০৯৭ জন নারী। অর্থাৎ ২৭.০৫ শতাংশ। পুরুষ মারা যান ৮৩৫৩ জন। অর্থাৎ ৭২.৯৫ শতাংশ। ৩০ এপ্রিল মারা যায় ৫৭ জন। এর মধ্যে নারী ২৫ জন, পুরুষ ৩২ জন। ৩১ মে পর্যন্ত মারা যায় ৩৫০৬ জন নারী। অর্থাৎ ২৭.৭৮ শতাংশ। পুরুষ মারা যান ৯১১৩ জন। অর্থাৎ ৭২.২২ শতাংশ। ৩১ মে মারা যায় ৩৬ জন। এর মধ্যে নারী ১১ জন, পুরুষ ২৫ জন। ৩০ জুন পর্যন্ত মারা যায় ৪১৭৮ জন নারী। অর্থাৎ ২৮.৮১ শতাংশ। পুরুষ মারা যান ১০৩২৫ জন। অর্থাৎ ৭১.১৯ শতাংশ। ৩০ জুন মারা যায় ১১৫ জন। এর মধ্যে নারী ৪৩ জন, পুরুষ ৭২ জন। ২৮ জুলাই পর্যন্ত মারা যায় ৬৩৮৯ জন নারী। অর্থাৎ ৩১.৯২ শতাংশ। পুরুষ মারা যান ১৩৬২৭ জন। অর্থাৎ ৬৮.০৮ শতাংশ। ২৮ জুলাই মারা যায় ২৩৭ জন। এর মধ্যে নারী ৮৮ জন, পুরুষ ১৪৯ জন।

নারীর মৃত্যুর হার বৃদ্ধির প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘নারীর মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদেরও নজরে আছে। এটি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। তথ্য উপাত্তগুলো এক জায়গায় হওয়ার পর আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারব।’

বিশেষজ্ঞরা ধারণা করে বলছেন, নারীরা বাসা বাড়ির বাইরে তুলনামূলক কম যান। বাসা বাড়ির যাওয়া অন্য সদস্যদের দ্বারাই তাদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা। বাড়ির বয়স্ক নারী যিনি বাইরে যান না, তার তো আক্রান্ত হওয়ার কথা না। ঘরে বসে তিনি তো আক্রান্ত হচ্ছে। আর বয়স্ক মানুষটি যখন আক্রান্ত হয়, তখন তার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া নারীদের প্রতি এক প্রকার উদাসীনতাও আছে। পরিবারের নারী সদস্য অসুস্থ হলে পুরুষের তুলনায় বেশি দেরিতেই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য এটা সব পরিবারের বেলায় না। বেশিরভাগ পরিবারেই এমনটা হয়। একেবারে শেষ মুহূর্তে হাপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাছাড়া টিকা কম নেওয়ার কারণে আক্রান্ত-মৃত্যু বেশি হতে পারে।

আইডিসিআর-এর উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নারীদের মৃত্যুর হার বৃদ্ধির বিষয়টি গবেষণা ছাড়া নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে সংক্রমণের হার বেশি হলে মৃত্যু বেশি হয়। আবার নারী সদস্যের প্রতি পরিবারের গুরুত্ব কম দেওয়া, সংক্রমিত হওয়ার পর অনেক দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসা- এসব কারণে মৃত্যু বেড়ে যাচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘এই ভ্যারিয়েন্টটার ছড়ানোর ক্ষমতা বেশি এবং ক্ষতিকারকও বেশি। সবাইকে সংক্রমিত করে ফেলছে। এটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ হচ্ছে পুরুষেরা বেশি টিকা নিয়েছে। নারীরা কম নিয়েছেন।’ 

তিনি বলেন, আমার দেখছি গর্ভবতী নারীরা বেশি মারা যাচ্ছেন। পেটের মধ্যে বাচ্চাও মারা যাচ্ছে। তার কারণ হচ্ছে মায়ের অক্সিজেন লেভেল কমে গেলে বাচ্চা অ্যাফেক্টেড হয়ে যায়। মায়ের অক্সিজেন লেভেল ৯২ থেকে ৯৪ এর মধ্যে থাকতে হবে। ৯২ এর নিচে নেমে আসলে তা পেটের সন্তানের জন্য ক্ষতি হয়ে যায়। বাসা বাড়িতে প্রসব হচ্ছে। অনেকের আবার অ্যাসেমটোমেটিক। সেখান থেকেও ছড়াচ্ছে।

দ্রুত এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ ব্যবস্থায় গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের টিকার আওয়াতায় তাগিদ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা এ বিষয়ে বার বার বলে আসছি। গর্ভবতীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়া এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই গর্ভবতী মায়েদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ইসরাইল বেশ আগেই শুরু করেছে, ইউকে, সম্প্রতি ইন্ডিয়াতেও শুরু করেছে। সুতরাং আমাদেরও বিলম্ব না করে যত দ্রুত সম্বব শুরু করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্ত থেকে জানা গেছে, ২৭ জুলাই পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৪৯০২৭৬০ জন পুরুষ এবং ৩১১৫৯২১ জন নারী। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২৭৫৪৪৩২ জন পুরুষ এবং ৫১৬১৩৩৬ জন নারী। এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারীর টিকা গ্রহণের হার অনেক কম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads