• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক চিঠি চালাচালি

রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তিকরণ হবে না

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ৩০ জুলাই ২০২১

বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে রোহিঙ্গা সংকট। বিপুলসংখ্যক শরণার্থী দেশে অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্দশার দৃশ্যপট নির্মাণ করেছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতায় এর কোনো ইতিবাচক প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়নি। অধিকন্তু এ সংকটকে ক্রমেই দীর্ঘায়িত ও জটিল করে তোলা হচ্ছে।

এদিকে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়ে চিন্তা করছে। একই সাথে বিদেশি অর্থদাতারাও চাইছে রোহিঙ্গাদের দক্ষ করে নিজেরাই যেন তাদের ব্যয় উপার্জন করে চলতে পারে। তবে জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি অর্থদাতাদের এ চিন্তার বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার। রোহিঙ্গাদের এ দেশে অন্তর্ভুক্তিকরণ হবে না, তাদের নিজ ভূমিতে টেকসই ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন আলোচনার অগ্রগতি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন কূটনীতিকরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গা সমস্যাটি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তৈরি। এখন তারা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, তারা খুব সহজে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় রাজি হবে না। তাই দেশটির ক্ষমতায় যেই থাকুক, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ-এর সমন্বয়কারী ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা বলেন, ১১ লক্ষাধিক বিপুলসংখ্যক বিদেশি শরণার্থীর কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান শুধু ওই অঞ্চলে নয়, পুরো দেশেই অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্দশার দৃশ্যপট নির্মাণ করেছে। নিরাপত্তাজনিত-পরিবেশগত-নানামুখী অপরাধ সংঘটনে এই জনগোষ্ঠীর কদর্য কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রায় নিগূঢ় প্রতিবন্ধকতা পরিগ্রহ করেছে। আন্তর্জাতিক আদালত হোক কিংবা প্রভাবশীল রাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভ করে হোক, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের দায়িত্ব বাংলাদেশের। তাই রোহিঙ্গা পুনর্বাসনই যদি রাষ্ট্রের ইচ্ছা হয়, তাহলে প্রত্যাবর্তনের বুলি না আওড়ে পুনর্বাসনের জন্যই সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করলেও মিয়ানমার তা করছে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহল সম্পৃক্ত থাকায় তাদের থেকে একটি চাপ থাকবে ওই দেশের সেনাবাহিনীর ওপর। তাছাড়া মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুর গুরুত্ব কিছুটা কম থাকবে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামলানোর প্রতি তাদের মনোযোগ থাকবে। তাই যেহেতু আমাদের চুক্তি মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে। আমি মনে করি, সাময়িক অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে। আর বাংলাদেশের উচিত হবে এটি নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার করা।

২০১৭ সালের আগস্ট থেকে মিয়ামারের সেনারা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে ‘হত্যা ও ধর্ষণ’ চালায় এবং রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘ, রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল, ইউনাটেড স্টেটস হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং আরো অনেকেই এ বিষয়টি দেখিয়েছে। সে সময় ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সহিংস গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এবং বাংলাদেশ এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিয়েছে। এরপর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুায়ারি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সম্পর্কিত একটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করে ঢাকা-নেপিডো, যা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়েছিল। মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থার অভাবের কারণে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে দুবার প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। 

এদিকে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রস্তাবিত ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’টি মতামতের জন্য পাঠায় এবং চিঠিতে উল্লেখ করে, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো মতামত না পেলে ওই প্রস্তাব সরকার মেনে নিয়েছে বলে তারা ধরে নেবে। বিশ্ব ব্যাংকের এই রিফিউজি পলিসি রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য দেশে অবস্থিত সব উদ্বাস্তুর জন্য প্রযোজ্য।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চাইলে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে মন্ত্রণালয়। উদ্বাস্তুদের আশ্রিত দেশের সমাজে অন্তর্ভুক্ত বা রেখে দেওয়ার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের প্রস্তাব মেনে না নিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিশ্ব ব্যাংকের ওই প্রস্তাব মেনে নিয়ে ওই সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বদলে তাদেরকে বাংলাদেশেই চিরতরে রেখে দিতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মন্ত্রণালয়। এজন্য ওই প্রস্তাবের পরিবর্তন না হলে উদ্বাস্তু সংক্রান্ত কোনো অর্থ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে না নেওয়ার লিখিত মতামত পাঠানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ওই বৈশ্বিক ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি উদ্দেশ্য হচ্ছে-১. উদ্বাস্তু  ও হোস্ট কমিউনিটির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা, ২. উদ্বাস্তুরা যেদেশে অবস্থান করছে সেই সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া অথবা তাদের ফেরত পাঠানো এবং ৩. দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাতে করে নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশ এই তিনটি উদ্দেশ্য আকারে-ইঙ্গিতে বা মুখে বলত; কিন্তু এই প্রথমবারের মতো তারা বিষয়টি লিখিত আকারে উপস্থাপন করল। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নিলে রোহিঙ্গারা যে-কোনো স্থানে চলাচল করতে পারবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পারবে বা ব্যবসা করতে পারবে। শুধু তাই না, তাদের নিবন্ধনের আওতায় এনে সামাজিক পরিচয়পত্রও দিতে হবে বলে তিনি জানান।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্পদ ব্যয় করছে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য অনেক দেশ তাদের দেখ-ভালের জন্য জাতিসংঘকে অর্থ প্রদান করে। এই অর্থ প্রদানের পরিমাণ দিনদিন কমে আসছে এবং এর ফলে বাড়তি বোঝা বাংলাদেশের ওপর চাপানোর একটি চেষ্টা আছে বিদেশিদের।

এ বিষয়ে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি অর্থদাতারা চাইছে রোহিঙ্গাদের উপার্জনের ব্যবস্থা যাতে করে নিজেদের ব্যয় তারা নিজেরাই মেটাতে পারে। এছাড়া তাদের জন্য শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, অবাধ চলাচলের বিষয়েও তারা জোর দিচ্ছে। এজন্য রোহিঙ্গাদের সিভিল নিবন্ধন অর্থাৎ পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধনসহ অন্যান্য বিষয় চালু করার প্রস্তাব করছে তারা বলে তিনি জানান।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য যদি আমরা এসব মেনে নিই তবে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্যগুলো আছে সেগুলো সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এজন্য আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। উদ্বাস্তু সমস্যা তিনভাবে সমাধান করা যায়। একটি আছে অন্তর্ভুক্তিকরণ, আরেকটি হচ্ছে তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট এবং অপরটি হচ্ছে প্রত্যাবর্তন।

তিনি বলেন, আমাদের জন্য তৃতীয় দেশে সেটেলমেন্ট ফিজিবল না, কারণ সংখ্যাটি অনেক বড়। যদি সংখ্যা ৩০ বা ৪০ হাজার হতো তাহলে বিভিন্ন দেশে ভাগ করে দেওয়া যেত; কিন্তু সংখ্যাটি ১০ লাখের ওপরে। এখন পৃথিবীর কোনো দেশ এই পরিমাণ মানুষ নেবে না এটাই বাস্তবতা।

আরেকটি সমাধান হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিকরণ। কিন্তু বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ এবং এখানে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিক আছে। ফলে বাড়তি শ্রমিকের কোনো প্রয়োজন এবং সে সম্ভাবনাও নেই। সুতরাং আমাদের জন্য একমাত্র অপশন হচ্ছে তাদের নিজ ভূমিতে টেকসই ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন। অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়ে জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংক চিন্তা করতে পারে; কিন্তু আমরা এটি করতে পারব না এবং এটি তাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, গতবারই তারা আমাদেরকে যখন এ ধরনের ভাষা বা পয়েন্ট বলেছিল তখন তাদেরকে আমরা বলেছি যে এটি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমাদের নজরে যেটি আসছে সেটি আমরা পয়েন্ট আউট করছি এবং সংশ্লিষ্ট যারা রয়েছে তাদেরকে বলছি যে, এ ধরনের শর্ত মানা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।

রোহিঙ্গাদের শিক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, যদি দিতে হয় তাহলে মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী দিতে হবে। কারণ আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই লোকগুলোর মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া। কিন্তু এমন কোনো ধরনের শিক্ষা যেখানে আমাদের এখানে অন্তর্ভুক্তি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে, এ ধরনের শিক্ষা আমরা দিতে চাই না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads