• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ষড়যন্ত্রের ফাঁদে বাংলাদেশ! 

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৩ আগস্ট ২০২১

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দ্বারা হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে রেখে দেওয়ার বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব এরইমধ্যে নাকচ করে দিয়েছে সরকার। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব বেআইনি, অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য। এটি আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না করে জিইয়ে রাখলে দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের চেয়েও সমস্যা বেশি ঘনীভূত হবে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিশৃঙ্খলা যথেষ্ট হুমকির মুখে পড়বে।

আর বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অর্থই হলো রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া। কারণ, বিষয়টি যেহেতু নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজেতে বিচারাধীন, সেদিক থেকেও এই প্রস্তাবকে বেআইনি বলে মত দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশি নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেসব সুযোগসুবিধা পায়, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদেরও তার সব সুবিধা দেওয়ার আবদার জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটির প্রস্তাব অনুযায়ী রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশে জমি কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ দেওয়া, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, নিজেদের মধ্যে নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া, তারা যাতে বাংলাদেশিদের মতো সব ধরনের কাজ করতে পারে সেই সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে বার্থ, ডেথ রেজিস্ট্রেশনসহ সব ধরনের সুযোগসুবিধা দেওয়ার বিষয়টি প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদের মতে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই প্রস্তাবের আন্তর্জাতিক ভিত্তি নেই এবং তারা ভূরাজনৈতিক কারণে প্ররোচিত হয়েই প্রস্তাবটি দিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিধান অনুযায়ীও তারা এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারে না।

তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘প্রস্তাবটি বাংলাদেশের কোনোভাবেই মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের হলেও রিফিউজি কনভেনশন অনুযায়ী এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং এক্ষেত্রে সবার দায় আছে। সেই দায়কে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া প্রহসনমূলক। আন্তর্জাতিকচক্র ক্রমেই সক্রিয় হয়ে উঠছে। আমাদের এই অঞ্চলের শান্তি বা স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আমাদের এখানে যেসব সমস্যা রয়েছে সেক্ষেত্রেও তারা রোহিঙ্গা ইস্যুটি ব্যবহার করতে চায়। বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার এ ধরনের উদ্ভট প্রস্তাব দেওয়ার অর্থ হচ্ছে-এতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে না।’

বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিস্ স্টাডিসের প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামানও। তার মতে, বিশ্বব্যাংক সমস্যাটা বাংলাদেশের ঘাড়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে। একবার কিছু থোক বরাদ্দ দিয়ে তাদের দায়বদ্ধতা থেকে সরে যেতে চাচ্ছে, যেটা গ্রহণযোগ্য না। অথচ জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সবাই এটা স্বীকৃতি দিয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যা চালানো হয়েছে।

তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবকে যদি আমরা মেনে নেই তাহলে গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়া হবে। যেটা কোনোভাবেই হতে পারেনা। এখানে শুধু ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করাই মুখ্য না, আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়টিও রয়েছে। কারণ, বিষয়টি বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন। সেই আদালত থেকে যেহেতু এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি, এটা নিয়ে কি করে বিশ্বব্যাংক এ ধরনের প্রস্তাব দেয়?’

রোহিঙ্গা ইস্যুকে নিয়ে প্রতিবেশী চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক রাজনীতির চাল চালছে। এরই অংশ হিসেবে চীনের সহযোগিতায় মিয়ানমার এই সমস্যা তৈরি করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আব্দুর রশিদ এমন মত দিয়ে বলেন, ‘এশিয়া অঞ্চলে চীনবিরোধী যে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে, সেই মেরুকরণে বাংলাদেশ যাতে অংশগ্রহণ না করে সেটি চীনের চাওয়া। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ যেসব দেশ চীনের বিরুদ্ধে যে মেরুকরণ তৈরি করছে সেখানে বাংলাদেশকে তারা যুক্ত করতে চায়। আর বাংলাদেশ যাতে সেই মেরুকরণে যুক্ত না হয় সেজন্যই চীন রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, মিয়ানমারে ভারতের স্বার্থ থাকায় এই ইস্যুতে তারা বাংলাদেশের পাশে থাকেনি।’

তার মতে, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান না হলে দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের চেয়ে সমস্যা বেশি ঘনীভূত হতে পারে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিশৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়বে। তাই সরকারকে সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমাধানের পরামর্শ দেন আব্দুর রশিদ।

অন্যদিকে, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুনিরুজ্জামানের মতে, এই প্রস্তাব সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের যেসব শক্ত যুক্তি রয়েছে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার যদি এই গণহত্যা করে পার পেয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বিশ্বের যেসব বিরোধপূর্ণ অঞ্চল রয়েছে সেখানেও গণহত্যার পুনরাবৃত্তি হবে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হবে।’

এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে ঢাকা রাজি নয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের অগ্রাধিকার ইস্যু হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন, রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে।’ তিনি গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংক একটা রিপোর্ট তৈরি করেছে, এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ১৬টা দেশের জন্য। যে সমস্ত দেশে রিফিউজি আছে সেখানে তাদের হোস্ট কান্ট্রিতে ইন্টিগ্রেট করার বিষয়ে। যেহেতু রোহিঙ্গারা রিফিউজি না, আমরা এটা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছি। এই রিপোর্টের সঙ্গে আমাদের চিন্তাভাবনার মিল নেই। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র পথ হচ্ছে নিজের দেশে ফিরে যাওয়া। আমরা তাদের ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় দিয়েছি।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কাছে বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রস্তাবিত রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্কটি মতামতের জন্য পাঠায়। চিঠিতে বিশ্ব ব্যাংক জানায়, বিশ্বব্যাংকের এই রিফিউজি পলিসি রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য দেশে অবস্থিত সব উদ্বাস্তুর জন্য প্রযোজ্য। প্রতিবেদন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে না নিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads