• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
৬ মাসে সাগরে সহস্রাধিক মৃত্যু

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

৬ মাসে সাগরে সহস্রাধিক মৃত্যু

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৪ আগস্ট ২০২১

চলতি বছরে ছয় মাসে অবৈধপথে ইউরোপ যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে সহস্রাধিক বাংলদেশি। এ অবস্থায় অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে সেখানকার আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটকদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ এখন অন্যতম। অবৈধপথে ইউরোপে অনুপ্রবেশকারী দেশগুলোর মধ্যেও রয়েছে শীর্ষে।

এনিয়ে গবেষণাও করেছে বিদেশি একটি সংবাদ মাধ্যম। বাংলাদেশ থেকে ১৮টি রুট ব্যবহার করে মানবপাচার করা হয় ইউরোপে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে ভূমধ্যসাগর।

সম্প্রতি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ইউরোপে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইতালিতে প্রবেশের জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন ৩ হাজার ৩০০ জনের বেশি বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে যাত্রাপথে সাগরে ডুবে মারা গেছেন ১ হাজারের বেশি। ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তারা বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিবছর যত মানুষ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষে আছেন বাংলাদেশিরা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন তিউনিসিয়ার অধিবাসীরা। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশসমূহের অনুপ্রবেশকারীদের থেকেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেশি।

অবৈধপথে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে সাগরে ডুবে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। আবার অনেক সময় অভিবাসন প্রত্যাশীদের জীবিতও উদ্ধার করা হয়। বন্দি হয় বিদেশে।

অবৈধপথে ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে তিউনিসিয়া ও লিবিয়ায় উদ্ধার এমন কয়েক-শ বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত আনছে সরকার। প্রাথমিক ধাপে দুটি চার্টার্ড ফ্লাইটে তাদের দেশে আনা হবে। প্রথম ফ্লাইটে লিবিয়ার বেনগাজি ও ত্রিপোলিতে থাকা ৩০০ জনকে ফেরত আনা হচ্ছে। দ্বিতীয় ফ্লাইটে তিউনিসিয়া থেকে আরো ২০০ বাংলাদেশিকে আনা হবে। এসব অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশি সেখানে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছিলেন। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে তারা দেশে পরিবারের কাছে আসার সুযোগ পাবেন। যদিও এখনো দিনক্ষণ ঠিক না হলেও চলতি মাসেই তাদের আনা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অভিবাসন প্রত্যাশীদের দেশে ফেরত আনতে সব ধরনের সহায়তা করছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও)।

করোনা মহামারিতেও অবৈধপথে বিদেশযাত্রা থেমে নেই। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে উত্তাল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ১৭ অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশির প্রাণ গেছে। নৌকায় অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে মারা যান তারা। তাদের মরদেহ উদ্ধার করেছিল তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এছাড়া জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের আরো ৩৮০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে। এর আগে গত ২৪ জুন ২৬৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। তাদের মধ্যে ২৬৪ জনই ছিলেন বাংলাদেশি।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে যদিও অন্যান্য বছরের তুলনায় ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশকারীদের সংখ্যা বিগত বছরগুলোর চেয়ে কম ছিল, কিন্তু তারপরও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়া ও মরক্কোর তুলনায় গত বছর বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।

বিদেশি গণমাধ্যম দি টেলিগ্রাফ সম্প্রতি এ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছে। তাদের অনুসন্ধানের মূলবিষয় ছিল-বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম, প্রতিবছরই জিডিপি বাড়ছে। এমনকি করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের জিডিপি যেখানে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা আছে; সেখানে বাংলাদেশের জিডিপি বাড়ার সম্ভাবনা আছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তাহলে কেন প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর ইউরোপে যেসব বাংলাদেশি প্রবেশ করেন, তাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আহমেদ মুশফিক মোবারক বলেন, ইউরোপে প্রবেশের জন্য প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করতে হয় এবং তাদের পরিবার সেই টাকার যোগান দেয়। এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা লোকজন।

তারা এই বিষয়টিকে দেখছে একপ্রকার বিনিয়োগ হিসেবে। আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার জমি বা বাড়ি নির্মাণের জন্য অর্থলগ্নি করত, এখন তারা নতুন খাত হিসেবে ইউরোপ প্রবেশকে বেছে নিয়েছে।

বাংলাদেশভিত্তিক উন্নয়নসংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, ইউরোপে বসবাস করা মানেই উন্নত জীবন, বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল। তাই প্রতিবছর ইউরোপে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশের সিলেটসহ কিছু জেলার মানুষের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে। সেটি হলো-আপনি যদি কোনোভাবে ইউরোপে যেতে পারেন, তাহলেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

বিভিন্ন সময় ফেরত আসা বাংলাদেশিরা আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে জানান, ইউরোপে নেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে মানবপাচারের একটি চক্র রয়েছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তাদের এজেন্ট রয়েছে। দালালদের কারো কারো কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। অনেক দেশের জঙ্গল ও মরুভূমিতে তাদের আস্তানা আছে।

অভিবাসন প্রত্যাশীদের আটকে অনেক সময় স্বজনের কাছে দেশে মুক্তিপণও দাবি করে মানবপাচারে জড়িত আন্তর্জাতিকচক্রের সদস্যরা। অর্থ না দিলে হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের জন্য রওয়ানা হন, তাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং তাদের একটি বিপুল অংশ লিবিয়া থেকে নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তিনি আরো বলেন, আমরা এই যুবকদের বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছি- এটা কোনো স্বপ্নপূরণের যাত্রা নয়; বরং মৃত্যু অভিমুখে যাত্রা। কিন্তু তারা এসব কথায় কান দিতে প্রস্তুত নন।

বিষয়টি সমাধানে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন উল্লেখ করে শরিফুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি, দালালদের ও ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির সদস্যদের গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ না করে ইউরোপ এবং বাংলাদেশ-উভয়কেই এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads