• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

শিশুদের স্কুলে পাঠাতে অনীহা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর খুলেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরই মাঝে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সরকারসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের দাবি, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হচ্ছে। তারপরও অনেক অভিভাবক এখনো সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেক অভিভাবককে সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করতে দেখে গেছে।

অভিভাবকরা বলেন, সন্তানদের স্কুলে না পাঠানোর পক্ষে তারা নন। তবে শিশুদের ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে নির্দেশনা না মানার আশঙ্কা কাজ করছে তাদের মধ্যে।

অভিভাবকদের এমন শঙ্কা-উদ্বেগ আমলে নিয়েই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করতে পারলে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে। তা ছাড়া শিশুরা স্কুলে গেলে সেটি তাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশে রাখবে ইতিবাচক ভূমিকা।

এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের করণীয় বিষয়ে বেশ বড় নির্দেশিকা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। তাতে স্বাস্থ্য খাতে সমতা, টিকাকরণ, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্কুলের সহযোগী কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বায়ু চলাচল (ভেন্টিলেশন), হাত ধোয়া-এসব বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া আছে। খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের সময় করণীয়ও উল্লেখ করা হয়েছে সিডিসির নির্দেশনায়।

অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুকরণ নির্দেশনা’ প্রকাশ করে এ বছরের জানুয়ারি মাসে। ৩৯ পৃষ্ঠার ওই নির্দেশনায় নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিকল্পনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করে তোলা, প্রতিষ্ঠান চালু করা এবং প্রতিষ্ঠান চলাকালে করোনার বিস্তার রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। এ ছাড়া এই কাজে কীভাবে অংশীজনদের যুক্ত করা হবে, বাড়তি অর্থ কীভাবে সংগ্রহ করা যাবে, সে বিষয়েও নির্দেশনা আছে।

ওই নির্দেশনায় মৌলিক কিছু মানদণ্ডও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে শ্রেণিকক্ষে, চত্বরে বা খোলা জায়গায় ১ মিটার বা ৩ ফুট দূরত্বে শিক্ষার্থীদের বসার বা চলাফেরার ব্যবস্থা করতে হবে। মাস্ক পরার বিষয়ে নির্দেশনায় বিস্তারিত আছে। বলা হয়েছে, ৬ থেকে ১১ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে মাস্ক পরা নির্ভর করবে রোগবিস্তারের ঝুঁকির ওপর। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, রোগবিস্তারের ঝুঁকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়; শিক্ষার্থীদের পক্ষে তো নয়ই।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একই ধরনের একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য। তবে এই দুটি নির্দেশনার বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা কমই জানে। নাখালপাড়ার বাসিন্দা তরিকুর রহমানের সাত বছর বয়সী সন্তান তেজগাঁও এলাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হলেও স্বাস্থ্যবিধি কতটা অনুসরণ হবে, সেটি নিয়ে সংশয় থাকায় সন্তানকে এখনই স্কুলে পাঠাচ্ছেন না তিনি। তরিকুর বলেন, সরকারি স্কুলগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে—এ বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারলে সন্তানকে পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। তারপরও হয়তো বাধ্য হয়েই সন্তানকে স্কুলে পাঠাব আরো কিছুদিন পর।

স্কুল খোলার পর থেকে মেয়েকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন অভিভাবক প্রতীক মাহমুদ। তিনি বলেন, আমার মেয়ে প্রথার বয়স ৫ বছর। নার্সারিতে পড়ে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি শুরুর পর থেকেই ঘরবন্দি। আগে স্কুলে যেত না। এ বছরের শুরুতেই একটি স্কুলে ভর্তি করে দিই। তখন থেকেই অনলাইনেই ক্লাস করছিল। এখন সপ্তাহে এক দিন করে স্কুলে যায়। আর দুই দিন করে ক্লাস হয় অনলাইনে।

শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য স্কুলে যাওয়াটা জরুরি বলে মনে করেন প্রতীক মাহমুদ। তিনি বলেন, গত বছর আমিসহ পরিবারের সবাই দুই বার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হই। তারপর থেকেই মেয়ের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করি। সে প্রায়ই বাইরে যেতে চায়। জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে প্রায়ই অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। কোনো কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে নিয়ে গেলে পরের দুয়েকদিন সে বেশ প্রফুল্ল থাকে। সেজন্য স্কুল খোলা এবং ক্লাসে যাওয়াটাকে আমি ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছি।

উত্তরার বাসিন্দা হাসিবা রহমানের মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ১২ সেপ্টেম্বর থেকেই সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। হাসিবা বলেন, মেয়ে মাস্ক পরে স্কুলে যাচ্ছে। গেটে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নিচ্ছে। ক্লাসরুমে বসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে একটু দূরে দূরে। এই ব্যবস্থাগুলো কিছুদিন গেলে ঠিকঠাক থাকবে কি না, সেটিই প্রশ্ন। তা ছাড়া তবে পঞ্চম শ্রেণি বলে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিন দিয়ে শুরু করতে পারত সরকার। পরে পরিস্থিতি বুঝে প্রতিদিন ক্লাস করানোর ব্যবস্থা করানো যেত।

এই অভিভাবক বলেন, আমরা সন্তানদের স্কুলে দিতেই চাই। কারণ অনলাইনে ক্লাস চললেও স্কুলের পড়ালেখার বিকল্প অনলাইন হতে পারে না। কিন্তু সন্তানের সুরক্ষার দিকটাতে আগে নজর দিতে হবে। প্রতিটি স্কুলে আইসোলেশন সেন্টার ও জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। শুধু করোনা নয়, ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মশা নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে। তার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন দেওয়া ভ্যাকসিন যেন শিশুরা পায়, সেটি দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, অনেকদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও স্কুল সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের ‘মোশন ইনারশিয়া’ কাজ করছে। থেমে থাকা অবস্থা থেকে হঠাৎ করে চলতে শুরু করলে এরকম প্রবণতা কাজ করে। তা ছাড়া অনেক অভিভাবকের মধ্যেই সন্তানদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কাজ করছে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না। অভিভাবকদের অনীহার পেছনে এসব বিষয় কাজ করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা সংক্রমণের ৩ শতাংশের বয়স ১০ বছরের কম। অন্যদিকে ১১ থেকে ২০ বছর বয়সিদের মধ্যে সংক্রমণের হার মোট সংক্রমণের ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে সংক্রমণের হার মোট সংক্রমণের প্রায় ১০ শতাংশ। ফলে সন্তানদের করোনা সংক্রমণ নিয়ে অভিভাবকদের যে আশঙ্কা, সেটিকেও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন মনোস্বাস্থ্যবিদ ড. হেলাল।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভাইরোলজিস্ট সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, শিশুদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার হার খুব একটা কম নয়। তবে তাদের শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হার কম। অন্যদিকে তাদের মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে সামগ্রিকভাবে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকছে।

শিশুদের স্কুলে যাওয়ার ইতিবাচক একটি দিকও তুলে ধরলেন ডা. জাহিদুর। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, সুস্থ-স্বাভাবিক শিশু-কিশোরদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ও কো-মরবিডিটির পরিমাণ কম থাকায় করোনার প্রভাব তাদের ওপর তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও তাদের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই স্কুলে পাঠাতে হবে। তবে আবারও বলছি, ঘর থেকে শুরু করে স্কুল পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যবিধির প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে এবং সেটি কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে।

শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ আঞ্জুমান পারভীন অভি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে যেসব স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, তা অনেকেই ঠিকমতো জানেন না। কতক্ষণ পরপর হাত ধুতে হবে বা স্যানিটাইজ করতে হবে, তার নির্দিষ্ট গাইডলাইন কি আমরা জানি? ক্লাসরুমের আকার অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ফাঁকা ফাঁকাভাবে বসার সুযোগ আছে কি না—এই প্রশ্নও থেকে যায়। ফলে অভিভাবকদের অনীহা অযৌক্তিক নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়েছে। কিন্তু স্কুল-কলেজ বছরের পর বছর বন্ধ থাকতে পারে না। আমার মতে আরও আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা উচিত ছিল। সমাজে এখনো শিক্ষকদের কথা অনেকেই শোনেন। তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরিতে কাজে লাগানো যেত।

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারপারসন তৌফিক জোয়ারদার বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার, স্বাস্থ্যবিধি মানা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা-এসব শেখানোর সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানোর সময় এখনই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads