• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

মানসিক সমস্যায় ৮৪ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১০ অক্টোবর ২০২১

করোনাকালে দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৮৪ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তাদের ৪ ভাগের ৩ ভাগ শিক্ষার্থী পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে।

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে, তা জানতে এই জরিপ করে আঁচল ফাউন্ডেশন। এর অংশ হিসেবে সামাজিক সংগঠনটি ২ দুই হাজার ৫৫২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেয়।

তাদের জরিপ প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে মন খারাপ থাকা, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া ও নিজেকে তুচ্ছ ভাবা।

ঢাকার সাভারের বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম। এইচএসসি পাস করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তে গিয়েছিলেন।  সেখান থেকে এক বছরের মাথায় ছুটিতে বাড়িতে আসেন মনিরুল। এরপর দেশে শুরু হয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ; বন্ধ হয়ে যায় সব দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ। এতে আটকে যায় মনিরুলের বিদেশযাত্রা।

করোনার মধ্যে অনলাইনে মনিরুল ক্লাস করলেও সেটা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এ হতাশা ও বিষণ্নতা থেকে মনিরুল অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। ওষুধ গ্রহণ করেন স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে। তাতে কোনো সমাধান না হওয়ায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন মনিরুল। গত এক মাস ধরে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা চলছে তার।

মনিরুলের স্ত্রী মরিয়ম বলেন, এক মাসের চিকিৎসায় মনিরুলের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসক বলেছেন আরো কিছুদিন এখানে থাকতে হবে। হতাশা ও বিষণ্নতা থেকে মনিরুলের এমন অবস্থা হয়েছে। এ জন্য করোনাভাইরাস সংক্রমণ দায়ী। মনিরুলের মতো লাখো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী করোনাকালে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।

জরিপে আরও উঠে এসেছে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় বেশি ভুগছেন শহরের শিক্ষার্থীরা। এতে অংশ নেয়া শহরের ৬৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া গ্রামের ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

জরিপ অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যাদের সংখ্যা মোট অংশগ্রহণকারীর ৮৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ।  প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণকারী ৭৩৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯১ জন বা ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েছেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, অনলাইনে হলেও পড়াশোনা চলমান থাকায় প্রাইভেটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা তুলনামূলক কম।

আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে মানসিক সমস্যার কিছু কারণ উঠে এসেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থী বা তার পরিবারের সদস্যদের করোনা, সঠিক সময়ে না ঘুমানো, পরিমিত ঘুম না হওয়া।

শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ যেহেতু অনলাইনের মাধ্যমে তাদের প্রাত্যহিক কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন, তাই দিনের বড় একটা সময় তাদের স্ক্রিনের সামনে কাটাতে হয়েছে। এ কারণে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে উঠে এসেছে জরিপে।

স্ক্রিনের সামনে দীর্ঘ সময় কাটানোতে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মাথাব্যথা, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং ঘুমেও ব্যাঘাত ঘটেছে।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা সংক্রমণের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। এতে অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যেই পড়ালেখার প্রতি অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে।

জরিপে প্রাপ্ত ফলে দেখা যায়, করোনা মহামারিতে পড়ালেখা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।

সমস্যা থেকে বের হওয়ার পথ নিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, সমস্যাটা এমন যে, এটা একপাক্ষিকভাবে সমাধান করা কঠিন। আমরা দেখতে পাই যেসব শিক্ষার্থী ঠিকমতো ঘুমাতে যায় না, তাদের মাঝে বিষণ্নতা বেশি। যারা অতিমাত্রায় ডিভাইস ব্যবহার করে তাদের ডিপ্রেশনের হার বেশি। পরিমিত ঘুম, সঠিক মাত্রায় ডিভাইস ব্যবহার, কোনো কিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থীর ভরসার জায়গা হচ্ছে পরিবার। কেউ যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে, সে যেন পরিবারের সাথে মন খুলে শেয়ার করতে পারে, সেই ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সন্তান এবং বাবা-মায়েদের মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রে সমাজেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর সমাজ কর্তৃক অযাচিত চাপ প্রয়োগ থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে সবার এগিয়ে আসা জরুরি। কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, অন্যের সাথে তুলনা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সাবধান হওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দীপন সরকার বলেন, করোনাকালে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে তাদের বন্ধুদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কমে গেছে। পাশাপাশি নিয়মিত পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবন ও সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীদের উচিত বন্ধু ও পরিচিতজনদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানো এবং নিজের জীবনের লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

তিনি বলেন, সর্বোপরি মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য প্রয়োজনে সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া এবং নিয়মিত কাউন্সেলিং নেওয়া।

আঁচল ফাউন্ডেশনের মতে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা মনের অভিব্যক্তি সহজে প্রকাশ করার সুযোগ পায়।

সংস্থাটি মনে করে, সরকারের উচিত ‘মনের সুরক্ষা’ নামের একটি অ্যাপ চালু করা, যার মাধ্যমে সারা দেশের যে কেউ তাদের মানসিক সমস্যা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে।

সবাইকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে একটি জাতীয় হটলাইন সেবা চালু করা যেতে পারে বলেও মত দিয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান মনিরা রহমান বলেন, মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবারের একটা লক্ষ্যই থাকে বিয়ে দেওয়া। অনেক পরিবার মনে করেছে করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ থাকায় তাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে তাই বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো। তাছাড়া মহামারিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে বন্ধন সেখানে অস্থিরতা দেখা গেছে। এর বেশিরভাগ প্রভাব পড়েছে নারীদের ওপর। তাই পুরুষদের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না থাকলে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করত। করোনার মধ্যে অনেকে স্বজন হারিয়েছেন। অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা, বয়স, স্বজন হারানো ইত্যাদির বিষয়গুলো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী। আর শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।

তিনি বলেন, অনেক অভিভাবক সন্তানদের কাছে অবাস্তব প্রত্যাশা করে থাকেন। তাছাড়া ছোটোবেলা থেকেই অনেক চাপে রাখেন। প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে অনেকেই মানসিক সমস্যায় ভোগেন। করোনা তাদের সেই সমস্যাকে আরও প্রকট করে দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহজাবিন হক বলেন, করোনাকালে মানুষের জীবনযাত্রা থেমে গেছে। শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে তেমনভাবে মিশতে পারেনি, কথা বলতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ,হতাশা, একাকিত্ব কাজ করেছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করেছে। অনেকে অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগেছেন। পরিবারের সব সদস্যদের বাড়ির মধ্যে একসঙ্গে বন্দি অবস্থার মতো জীবন যাপন করতে হয়েছে। এসব সমস্যার কারণেই শিক্ষার্থীদের মহামারির এই সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এই সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব না। এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলছে তাই শিক্ষকদের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের চাপ না দিয়ে তাদের পাশে থাকা। তাদেরকে সময় দেওয়া। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখার জন্য বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেশি বেশি যোগাযোগ করা, একাকি না থাকা, সময় মতো খাওয়া-দাওয়া, ঘুমসহ মানসম্মত জীবনযাপন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads