• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
মুদি দোকানি থেকে মানবপাচারকারী

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

কয়েক কোটি টাকা  হাতিয়েছেন টুটুল

মুদি দোকানি থেকে মানবপাচারকারী

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০২১

এইচএসসি পাস সাইফুল ইসলাম টুটুল ছিলেন মুদি দোকানি। দ্রুত ধনী হওয়ার আশায় মেহেরপুরের গাংনী থেকে রাজধানী ঢাকায় আসা-যাওয়ার মাঝেই জড়িয়ে পড়েন মানবপাচারচক্রে। শুরুতে দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সিতে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতেন। পরে নিজেই খুলে বসেন তিনটি ওভারসিজ প্রতিষ্ঠান। আর বিদেশে লোক পাঠানোর মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কয়েক কোটি টাকা।

র্যাব জানায়, টুটুলের তিন প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় অন্য বৈধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেকার ও শিক্ষিত অর্ধ-শতাধিক নারী-পুরুষকে বিদেশে পাচার করেছেন। তার এই প্রতারণার কাজে সহযোগী তৈয়ব আলী চা দোকানি হলেও পরিচয় দিতেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত এয়ারলাইনসের ম্যানেজার হিসেবে।

মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারীচক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ আটজনকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পেয়েছে র‍্যাব। গত মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত বাড্ডা লিঙ্ক রোডের টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-সাইফুল ইসলাম টুটুল, তৈয়ব আলী, শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন, মারুফ হাসান, জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন, আব্দুল্লাহ আল মামুন।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, সম্প্রতি কয়েকজন নারী ভিকটিমের অভিভাবকের মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে র‍্যাব-৪ ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত বাড্ডার লিংক রোডে টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালিয়ে দুই নারীসহ চারজন ভিকটিম উদ্ধার করা হয়। এসময় দশটি পাসপোর্ট, সাতটি ফাইল, ব্যাংকের চেক বই, দুটি কম্পিউটার, তিনটি লিফলেট এবং নগদ ১০ হাজার টাকাসহ আট মানবপাচারকারীচক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের উত্থান : মোজাম্মেল হক বলেন, এইচএসসি পাশ টুটুল মেহেরপুরের গাংনী থানার কামন্দী আমে মুদি দোকানদার হিসেবে কাজ করত। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসত। লোভে পড়ে মানবপাচারকারীচক্রে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো শুরু করে। পরে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় খুলে বসেন টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ নামক তিন ওভারসিজ এজেন্সি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তাদের নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে টুটুল।

টুটুলের প্রতারণার অন্যতম সহযোগী ছিলেন আবু তৈয়ব। পড়াশুনা না জানা তৈয়ব চায়ের দোকানদান হলেও পরিচয় দিতেন স্বনামধ্যম এয়ারলাইনসের ম্যানেজার হিসেবে। টুটুলের প্ররোচনায় চক্রে জড়িয়ে প্রতারণামূলকভাবে বিদেশে মানবপাচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। অনেককে দিয়েছেন চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্রও।

মানবপাচারচক্রের অন্যতম সহযোগী শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন ও মারুফ হাসান ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী। জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিকেল সম্পূর্ণ করাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করে আসছিলেন।

যেভাবে বিদেশে পাচার করতেন : প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে চক্রের সদস্যরা বেকার ও অসচ্ছল যুবকদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসা-বাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নাম করে প্রলুব্ধ করতেন। এরপর বিদেশ যেতে আগ্রহীদের ঢাকায় মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের কাছে পাঠাতেন।

টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে এনে ভিকটিমদের বিদেশে বাসাবাড়িতে কাজের নামে পাঠানোর উদ্দেশে ভুয়া মানি রিসিপ্ট দিতেন। এ বাবদ প্রতিজনের কাজ থেকে নিতেন দুই থেকে ৫ লাখ টাকা। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পাচারকারীচক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতেন।

চাকরি দেওয়ার উদ্দেশেও প্রতারণা : চক্রের অন্যতম মূলহোতা গ্রেপ্তার তৈয়ব নিজেকে স্বনামধন্য এয়ারলাইনসের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকরির কথা বলে যোগাযোগ করেন। এরপর নিজ কার্যালয়ে নিয়ে আসতেন। বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরিসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চাকরির যোগদানপত্র প্রদান করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তৈয়ব।

র্যাব-৪ এর সিও মোজাম্মেল হক বলেন, বৈধ কোনো জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। তবে বৈধতার আড়ালে কেউ যাতে মানবপাচার করতে না পারেন সেজন্যই র্যাবের অভিযান। জনশক্তিখাতকে শুদ্ধ ও ভাবমূর্তি রক্ষাই অভিযানের মূললক্ষ্য।

 

বৈধতা না থাকার পরও কীভাবে মানবপাচার করেছিল টুটুল-তৈয়বচক্র এমন প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল হক বলেন, তাদের তিন ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় অন্য বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্ধশতাধিক মানুষকে পাচার করেছেন। এছাড়া শতাধিক মানুষকে বিদেশে পাঠানো কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ২৫ জনের মতো ভুক্তভোগী র্যাবে যোগাযোগ করেছেন। প্রতারিত ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads