• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

এক লাখ রোগীর সেবায় একজন

স্বাস্থ্যসেবায় অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট সংকট

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৭ অক্টোবর ২০২১

দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে ভয়াবহ অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট (অবেদনবিদ) চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এ কারণে অনেক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার এবং আইসিইউ বন্ধ থাকে। এ সংকট কাটানোর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সরকারের কাছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে স্বল্প মেয়াদের পরিকল্পনায় সাড়া দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে বেশ কিছু চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের এখনো পদায়ন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এ অবস্থায় চিকিৎসা খাতের অতিগুরুত্বপূর্ণ এ পদটিতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।

জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাগুলোতে সার্জন আর অ্যানিস্থিশিওলজিস্টদের অনুপাত খুবই কম। সদর হাসপাতালগুলোতে সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, নাক-কান-গলাসহ সব বিভাগেই একজন সিনিয়র ও একজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট থাকেন। কিন্তু  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট থাকেন একজন। কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ দুজনের দেখা মেলে। যদিও সার্জন ও অ্যানিস্থিশিওলজিস্টদের সংখ্যা সমান বা কাছাকাছি হওয়া জরুরি। অ্যানিস্থিশিওলজি বিভাগের এ অবস্থার জন্য হাসপাতালগুলোতে যথাযথ পদ না থাকা, প্রাইভেট প্র্যাকটিসে উপযুক্ত সম্মানি না থাকার মতো কারণগুলো উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের হিসাবে, বর্তমানে দেশে সরকারি বেসরকারি মিলে বিভিন্ন ক্যাটাগরির তিন হাজারের মতো অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট রয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে পদ ও অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের সংখ্যা হাজারের মতো।  সোসাইটির ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে ১ লাখ রোগীর বিপরীতে শুণ্য দশমিক ৭৩ জন ছিলেন। এখন এটি লাখে ১ জনে এসে পৌছেছে। উন্নত  বিশ্বে যেখানে এক লাখ রোগীর জন্য ২০ জন অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট রয়েছে, সেখানে দেশে মাত্র ১ জন। এছাড়া এ সংখ্যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ীও অনেক কম।

চিকিৎসার মান ঠিক রাখতে অ্যানিস্থিশিয়া চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব সোসাইটি অব অ্যানিস্থিশিওলজিসের (ডব্লিউএফএসএ) মতে, প্রতি লাখ রোগীর বিপরীতে পাঁচজন করে অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট থাকা দরকার। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

বিশেষ করে করোনার সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বগতি ছিল, তখন আইসিইউতে রোগীদের চিকিৎসায় অ্যানিস্থিশিওলজিস্টদের অভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের অভাবে অনেক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকে এমন তথ্যও আছে

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট জানায়, মোট অবেদনবিদদের মধ্যে সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন প্রায় ১৮০০ চিকিৎসক। এদের বড় অংশ নিয়মিতভাবে অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু চিকিৎসাসেবার মান ঠিক রাখতে প্রতি লাখে ৫ জন করে অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট থাকা দরকার বলে মনে করেন সংগঠনটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। একই সঙ্গে আলাদা আলাদা বিষয়ে দক্ষ অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট গড়ে তোলা সম্ভব হলে চিকিৎসার মান বাড়বে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

করোনাকালেই ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসার জন্য গত বছরের অক্টোবরে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আর এ বছরের এপ্রিলে স্থাপন করা হয় ১৫টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ)। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইসিইউ ও এইচডিইউ’র কোনোটিই চালু করা যায়নি। আর এই আইসিইউ ও এইচডিইউ চালু না হওয়ার জন্য দায়ী জনবল সংকট।

আইসিইউ ও এইচডিইউ চালু করতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে গত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট পাঁচ বার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। আর তাই মানুষ যখন একটা আইসিইউ বেডের জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরছে, সে সময় ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউগুলো অব্যবহূত অবস্থায় পড়ে আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, করোনাকালে মানুষকে চোখের সামনে আইসিইউ বেডের জন্য হাহাকার করতে দেখেছি। অথচ আমার হাসপাতালেই আইসিইউ বেড পড়ে আছে। কেবল প্রশিক্ষিত জনবল, অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের অভাবে এই আইসিইউ ইউনিট চালু করা যায়নি।

ঝালকাঠির রোগীরা করোনাকালে ছুটে গেছেন জেলা সদর হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত সুবিধার অভাবে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো বিভাগীয় শহর বরিশালে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ছিল না আইসিইউ সুবিধা, সেইসঙ্গে অক্সিজেন সংকটও ছিল প্রবল। চিকিৎসক ছিলেন ১০ জন, এর মধ্যে অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট ছিলেন মাত্র একজন।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সার্জন মূলত সংশ্লিষ্ট রোগীর অস্ত্রোপচার করেন। অস্ত্রোপচার শেষে তার খুব বেশি কাজ না থাকলেও একজন অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের কাজ শুরু হয় অপারেশনের আগে রোগীকে অজ্ঞান করার মধ্য দিয়ে। সার্জন যখন অস্ত্রোপচার করেন তখনো অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের রোগীর দিকে সতর্ক নজর রাখতে হয়। কারণ অপারেশনের মধ্যেও রোগীর ব্যথা উঠতে পারে। একটা অপারেশন তখনই সফল হয় যখন রোগীর ব্যথামুক্তভাবে জ্ঞান ফিরে আসে। অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট একটু অসতর্ক হলেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কোনো রোগীকে আইসিইউতে নেয়ার প্রয়োজন হলে সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয় একজন অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অ্যানিস্থিশিওলজি বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, বিদেশে অ্যানিস্থিশিয়া যতটা মূল্যায়িত হয়, বাংলাদেশে সে রকম হয় না। একজন সার্জনকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, একজন অ্যানিস্থিশিওলজিস্টকে সেভাবে করা হয় না। দেশের বাইরে একজন অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট ফিজিশিয়ান, আর আমাদের দেশে কেবলই অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট।

তিনি বলেন, আমাদের পেশায় অ্যানিস্থিশিওলজিস্টরা কোনও ওয়ার্ড সুপারভাইজ করেন না। রোগী থাকে সার্জনদের হাতে। অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট রোগীদের ‘ডিল’ করেন কেবল অপারেশন থিয়েটারে। এ কারণে সার্জনদের একটি কমন প্রবণতা হচ্ছে, তারা মনে করেন রোগী তাদের। তারা ভাবেন রোগীদের প্রতি অ্যানিস্থিশিওলজিস্টদের দায়বদ্ধতা তাদের তুলনায় কম। দেখা যায়, সার্জনদের এই মনোভাবের কারণে অ্যানিস্থিশিওলজিস্টরা ভেতরে ভেতরে অসন্তুষ্ট থাকেন। একই কোয়ালিফিকেশন নিয়ে যখন একজন অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট কম মূল্যায়িত হন, তখন ডিসিপ্লিনের প্রতি টেলেন্টেড চিকিৎসকদের আগ্রহ কমতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিস্থিশিয়া বিভাগের চিকিৎসক ও অ্যানিস্থিশিওলজিস্টদের সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, এই সংকট কাটানোর জন্য সরকারের কাছে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জমা দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে স্বল্প মেয়াদের পরিকল্পনায় সাড়া দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে বেশ কিছু চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের এখনো পদায়ন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। আশা করি সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখবে।

ডা. দেবব্রত বণিক আরো বলেন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করা যেসব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট রয়েছেন তাদের অর্ধেক সরকারি এবং অর্ধেক বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করছেন। এ ছাড়া ৬ মাস বা এক বছরের প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ কেউ কাজ করছেন। কিন্তু উন্নত বিশ্বে একজন রোগীকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার জন্য আলাদা আলাদা বিষয়ে দক্ষ অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট থাকেন।

বাংলাদেশসোসাইটি অব অ্যানিস্থিশিওলজিস্টের সাধারণ সম্পাদক ও বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসক কাওসার সরদার বলেন, যেকোনও অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন অ্যানিস্থিশিওলজিস্টরা। অথচ দেশজুড়ে জনবলের অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইসিইউ চালু করা যায়নি, এর অন্যতম কারণ ছিল অ্যানিস্থিশিওলজিস্ট সংকট। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ সংকটের কথা একাধিকবার স্বীকার করেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন পদ সৃষ্টি করে চাহিদার আলোকে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলে রোগীরাই উপকৃত হবেন বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads