• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে ১৮ জলযান!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৩ অক্টোবর ২০২১

নিম্নমানের জাহাজ নির্মাণের অভিযোগ ও মেঘনাখেকো হিসাবে পরিচিত ‘থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড’ তৈরি করছে গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি সরকারি জলযান। অভিযোগ উঠেছে, বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ’র  ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ওই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়েছে। তাই ৩৫টি বাণিজ্যিক জলযান নির্মাণ প্রকল্পের ১৮টির কাজই পেয়েছে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড। 

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, অতীতে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের তৈরি করা জলযানগুলোর মান ভালো ছিল না। নিম্নমানের ইঞ্জিন এবং ধাতবসামগ্রী ব্যবহার হওয়ায় বেশকিছু জলযান ও সহায়ক জলযান পানিতেই নামানো যায়নি। সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এসব বিষয় বার বার জানানোর পরেও আবারো প্রতিষ্ঠানটিকে বিপুল পরিমাণ টাকার সরকারি জলযান তৈরি করতে দেওয়া হয়েছে। একারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।

এদিকে যোগ্যতা ও নিয়ম মেনেই থ্রি এঙ্গেল মেরিনকে কাজ দেওয়া হয়েছে দাবি করে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান বলেন, থ্রি এঙ্গেল আগেও তাদের জলযান বানিয়ে দিয়েছে। সেসব জাহাজে তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। এবারের কাজের মান আরো ভালো হবে বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধাররা অঙ্গীকার করেছেন।  

সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিআইডব্লিউটিসি এই ৩৫টি বাণিজ্যিক জলযান ও আটটি সহায়ক জলযান তৈরি করছে। এ জলযানগুলো তৈরি করতে সংস্থটি ব্যয় করছে এক হাজার ৩১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৮ সালের জুলাইয় থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এর মধ্যে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের টেন্ডার পেয়ে ১৮টি জলযান নির্মাণ করছে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড। অথচ নৌ-নির্মাণ এ প্রতিষ্ঠানটি নিম্নমানের জাহাজ নির্মাণ ও নদী দখলের জন্য পরিচিত।

থ্রি এঙ্গেল মেরিন যেসব জলযান তৈরির কাজ পেয়েছে সেগুলো হলো-ছয়টি ইউটিলিটি ফেরি, দুটি কোস্টাল অয়েল ট্যাংকার, দুটি ফায়ার ফাইটিং টাগ, তিনটি মডার্ন ইনল্যান্ড প্যাসেঞ্জার ভেসেল, চারটি কোস্টার সি ট্রাক ও একটি ইন্সপেকশন বোট। এসবের জন্য মোট নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৮ কোটি ৪৯ লাখ ৬২ হাজার ৮৫০ টাকা। এরমধ্যে ইউটিলিটি ফেরির কাজ ৩০ শতাংশ এগোলেও বাকিগুলোর অগ্রগতি ১০ শতাংশের কম।

অন্যদিকে দেশের অন্যতম প্রধান নদী হিসেবে বিবেচিত মেঘনা ও এর শাখা নদী ফুলদীর একাংশ ভরাট করে জাহাজ মেরামত-নির্মাণ কারখানা গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে থ্রি এঙ্গেল মেরিনের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ৬ মে মুন্সীগঞ্জ জেলার নদী দখলদারদের একটি তালিকা জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা। ওই তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির নাম রয়েছে শীর্ষে। যাতে বলা হয়েছে, নয়ানগর মৌজার ১ নং খতিয়ানের ৮৯৯, ৮৯০, ৯০০, ৯০১, ৯০৪, ৯০৮, ৯১০, ৯১১ ও ৮৪৮ নম্বর দাগের জমিসহ মেঘনা ও ফুলদী নদীর অংশবিশেষ দখল করেছে থ্রি এঙ্গেল।

এছাড়া মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার দৌলতপুরে প্রতিষ্ঠানটি দুটি খালও পুরোপুরি ভরাট করে বহুতল বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছে। দখল ও ভরাটের ফলে সংকুচিত হয়ে পড়ায় ফুলদী নদী দিয়ে বড় ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারছে না। এতে সেখানকার পাঁচটি খাদ্যগুদামসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, থ্রি এঙ্গেলের বিরুদ্ধে নদী ও খাল দখলের অভিযোগ তারা পেয়েছেন। এ বিষয়ে তদন্তও চলছে। প্রতিষ্ঠানটি খাসজমি দখল করেছিল, এটি সত্য। তবে পরে সেসব উদ্ধার করা হয়েছে। আর এখন তাদের বিরুদ্ধে নদী দখলের যে অভিযোগ পাওয়া গেছে সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হলে ভূমি মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সমন্বয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (লজিস্টিক সাপোর্ট) এমএ রহমান আনসার বলেন, আমরা ৭১ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছি। নয়ানগর গ্রামের অল্প কিছু অংশ বাকি আছে। পুরো গ্রামটিকেই মেরিন শিল্পের জন্য ব্যবহার করার পরিকল্পনা আছে।

তবে নদী ও খাল দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। উল্টো মেঘনা নদীর অংশে তাদের জমি বালি ব্যবসায়ীরা দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, তারা যে নদী দখল করেননি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো বিআইডব্লিউটিএ যখন নদীর জমি দখলমুক্ত করে তখন তাদের সীমানা প্রাচীর ভাঙেনি। তবে নদীর ফোরশোর ভূমি খালি রাখা আইনের প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, নদীর ভেতরেও আমাদের জমি আছে। আমাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ ড্রেজিং করে সে জমি থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে।

এসব বিসয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম জানান, ২০০৯ সাল থেকে তারা এখানে জমি কিনছেন। যথাযথ আইন মেনেই সব জমি কিনেছেন তারা। যদি সবকিছু নিয়ম অনুযায়ীই করে থাকেন তাহলে কেন তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ উঠছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আগে বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশলী ছিলাম। পরে নিজের ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু প্রাক্তন সহকর্মীদের কয়েকজন বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেননি। অনেকেই আমাকে সহযোগিতা করলেও কেউ কেউ জমি দখলের মিথ্যা অভিযোগ রটাচ্ছেন।

এত বড় প্রতিষ্ঠান কেন শুধু সরকারি সংস্থার জন্য জলযান তৈরি করে, এমন প্রশ্নের জবাব দেন বিআইডব্লিউটিএর সাবেক এ প্রকৌশলী। তিনি বলেন, বেসরকারি কাজে অর্থপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে না। কিন্তু সরকারি কাজে এ ভয় নেই।

এদিকে, থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে ব্যবসা করে তারা। এরই মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ তাদের কাছ থেকে একটি টাগবোট, পাঁচটি ক্রেন, একটি ক্রু-হাউজবোট, পাঁচটি বার্জসহ ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কিনেছে। এসব জলযান নির্মাণ মান নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া থ্রি এঙ্গেলের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা দামের একটি জরিপ জাহাজও কিনবে বিআইডব্লিউটিএ।

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন থ্রি এঙ্গেল আগেও তাদের জলযান বানিয়ে দিয়েছে। সেসব জাহাজে কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। এখন যেসব জলযান তৈরি হচ্ছে তা সংস্থার থেকে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। তাই এগুলোর মান আগের তুলনায় ভালো হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads