• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ গৃহীত জাতিসংঘে

সুফল পেতে প্রয়োজন সংস্কার

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ২৬ নভেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ অনুমোদন দিয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। গত মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের ৪০তম প্লেনারি সভায় এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করল। আগামী পাঁচ বছর অর্থাৎ, ২০২৬ সাল নাগাদ উত্তরণের প্রস্তুতির জন্য সময় পাবে বাংলাদেশ। তবে এই সময়ে এলডিসি থেকে উত্তরণের যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলোর কোনোটির ব্যত্যয় ঘটলে চূড়ান্ত স্বীকৃতিলাভে বিলম্ব হবে।

তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চূড়ান্ত স্বীকৃতিলাভের ২০২৬ সালের পর থেকে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে রপ্তানির ক্ষেত্রে বর্তমানে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাংলাদেশ পাচ্ছে; তখন তা পাওয়া যাবে না। একারণে, বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের পাশাপাশি সরকারকে নানামুখী অর্থনৈতিক সংস্কার, দেশে করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মানোন্নয়নেও গুণগত সংস্কার আনার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশের খবরকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অর্থনীতির সব রিফমস্রে (সংস্কার) কথা বলেছেন, কিন্তু করদাতার সংখ্যা ২৫ লাখ থেকে ১ কোটি করার কথা কোথাও বলেননি। করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যা যা করার দরকার করতে হবে।’

দারিদ্র নিরসনকে উন্নয়নের মডেলকে বিশ্বব্যাংকের ভ্রান্ত একটা মডেল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন মডেলে যেতে হবে। এটা করলে লাভ যেটা হবে-বড় ইন্ডাস্ট্রি জিডিপি গ্রোথে বড় যোগান দেয়। আর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্মসংস্থান করে আয় রোজগার দারিদ্র্য এবং বৈষম্য কমায়।’ গুণগত শিক্ষায় কোনো অগ্রগতি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাকে মাধ্যমিক পর্যন্ত কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন অনুযায়ী বৃত্তিমূলক করতে হবে। আর উচ্চশিক্ষাকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। আর অর্থনৈতিক খাত বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা দরকার।’ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের মর্যাদা বিশ্বে আরো সমন্নুত হবে। তিনি বলেন, ‘এলডিসি দেশ হিসেবে কি যে অবহেলার স্বীকার হতে হয়, একটা মিসকিন অবস্থা, কতটা যে নিগৃহীত হতে হয়; এটা আমরা যারা ডিল করেছি তারাই জানি। খুবই লজ্জাজনক, অপমানজনক।’

এলডিসি দেশ হিসেবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশ পেয়ে থাকে সেসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় অর্থনীতিবিদদের অনেকেই প্রস্তুতির সময়টাকে আরো দুবছর বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে এটিকে ‘অবিবেচনাপ্রসূত’ উল্লেখ করে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘আমি এটার খুব শক্তভাবে বিরোধিতা করি। ডেভেলপিং কান্ট্রিতে উন্নীত হলে প্ল্যানিং কমিশনের হিসাব অনুযায়ী রপ্তানিতে যে ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে এটা বিবেচনাপ্রসূত নয়। কারণ, ডেভেলপিং কান্ট্রি হলে অন্য ডেভেলপিং কান্ট্রিগুলো এর সঙ্গে পার্টনার হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে এবং আছে। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য যে কতটা বাড়বে সেটা প্ল্যানিং কমিশন পরিমাপ করতে পারেনি।’

এদিকে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার ঘটনাকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার ‘মাইলফলক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বুধবার মধ্যরাতে এই খবর প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের যে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন যাত্রা- এটি তারই একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই সাফল্যের অংশীদার এই দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ।’ তিনি বলেছেন, ‘এই ঐতিহাসিক অর্জন বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এক মহান মাইলফলক। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির পিতা, মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণে তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে এই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।’

এছাড়া, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ায় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা কথা উড়িয়ে দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনে স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলেও বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানিসহ বাণিজ্যিক সুবিধা আরো পাঁচ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদের পঞ্চদশ অধিবেশনে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ আলোচনায় অংশ নিয়ে এ কথা বলেন।

বাংলাদেশের পাশাপাশি লাওস ও নেপালও উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। সাধারণত প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হলেও মহামারির অভিঘাতে অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলে উঠতে এই বাড়তি সময় দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। সেই শর্ত পূরণ হওয়ায় চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা ইউএন-সিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায় বাংলাদেশ।

উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট ২০২০ সালে ছিল ৭৫.৩।

অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে সেই দেশকে এলডিসিভুক্ত রাখা হয়, ৩২ এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট ২৫ দশমিক ২। সাধারণ পরিষদে তিন দেশের উত্তরণের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা।

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখেছেন। কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াবহতম সময়েও সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি বাংলাদেশের এই অদম্য অগ্রযাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার ফলে আজ রূপকল্প-২০২১ পূর্ণতা পেল।’

এলডিসি থেকে উত্তরণ পাওয়া এবং উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর জন্য প্রণোদনাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সহায়তা কাঠামো নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্ব দেন রাবাব ফাতিমা। তিনি উত্তরণ চ্যালেঞ্জের প্রতিটি দিক, বিশেষ করে উত্তরণ পরবর্তী আন্তর্জাতিক সহায়তা, বাধাহীন উত্তরণ এবং এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়নের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরিরও আহ্বান জানান।

জাতিসংঘ ১৯৭১ সালে কিছু নির্ণায়কের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি হিসেবে পৃথকভাবে শ্রেণিবদ্ধ করে। ১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ছিল ২৫, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৪৬-এ। এর আগে বতসোয়ানা, কেপভার্দে, মালদ্বীপ, সামোয়া, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও ভানুয়াতু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads