• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

অর্থপাচার ঠেকাতে পারছে না দুদক

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০২১

নানা পন্থায় প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা। এই অর্থপাচার বন্ধে প্রয়োজনীয় আইন রয়েছে। পাচারকারীর জেল ও জরিমানা এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তেরও বিধান আছে। কিন্তু আইনটি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। ফলে দেশ থেকে অর্থপাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। এমনকি পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং অর্থপাচার বন্ধে আশার আলোও কমে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে এবং পাচার রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তেমন কোনো ভূমিকা নেই। তাই পাচার রোধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এক্ষেত্রে চিহ্নিতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে কঠোর বার্তা দিতে হবে।

অভিযোগ আছে, বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হলেও এর বিরুদ্ধে দুদকের তেমন কিছু করার নেই। দুর্নীতি দমনে রাষ্ট্রীয় একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, আগে সকল অর্থপাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও দুদক আইন সংশোধনের পর তা সীমিত হয় পড়েছে। ফলে অর্থপাচার রোধে (মানি লন্ডারিং) বিদ্যমান আইনে দুদুকের তেমন কিছু করার এখতিয়ার নেই। তারপরেও বিদ্যমান আইনের মধ্যে যতটুকু করা সম্ভব সে ভাবে কাজ করে যাচ্ছে দুদক। 

অন্যদিকে মূলধনী যন্ত্রপাতি কিংবা পণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানির আড়ালে চোখের সামনেই আইনি কাঠামোর মধ্যে পাচার হচ্ছে দেশের টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন কৌশলে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে থাকে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ, ওভার ইনভয়েসিং (আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো) ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো) মাধ্যমে এসব অর্থপাচার হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থপাচার সংক্রান্ত তিন হাজারের মতো প্রতিবেদন জমা রয়েছে। যা নিয়ে কাজ করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচটি সংস্থা। সংস্থাগুলো হলো-দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় থাইল্যান্ড, দুবাই, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, চীন, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত, নেদারল্যান্ডস, বুলগেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড ও বেলজিয়ামে। ওই সময় কাস্টম আইনে লাইসেন্স বাতিলসহ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আলোকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কিংবা পাচার করা অর্থফেরতের দৃশ্যমান উদ্যোগ আর দেখা যায়নি।

এদিকে গতবছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক সুপারিশে অর্থপাচারে সহায়তাকারী ব্যাংক কর্মকর্তা ও শুল্ক শাখার অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিল এনবিআরের তদন্ত দল। অজানা কারণে ওই সুপারিশ ফাইলবন্দি হয়ে যায়। তবে এনবিআর-এর সুপারিশে ওই প্রতিবেদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে প্রতিষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এরপর অর্থপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ধরন এবং তাদের আমদানি করা পণ্যের বিবরণসহ অডিট রিপোর্ট ও তদন্ত প্রতিবেদন তলব করে। তবে দুদকের অনুসন্ধান কমিটির কর্মকর্তারা জানান,  বিদ্যমান আইনে এ বিষয়ে বড় ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের এখতিয়ার নেই দুদকের।

অন্যদিকে গতকাল রোববার অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ১৪টি প্রতিষ্ঠান ও ২৯ ব্যক্তির তালিকা আদালতে দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই তালিকা দাখিল করেন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তালিকায় রয়েছেন-আব্দুল আউয়াল মিন্টু মাল্টিমোড লিমিটেড, অ্যাংকর টাওয়ার, ১০৮ বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা। মিজ নাসরিন ফাতেমা আউয়াল, মাল্টিমোড লিমিটেড, অ্যাংকর টাওয়ার, ১০৮ বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা। তাবিথ আউয়াল, মাল্টিমোড লিমিটেড, অ্যাংকর টাওয়ার, ১০৮ বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা। তাফসির আউয়াল, মাল্টিমোড লিমিটেড, অ্যাংকর টাওয়ার, ১০৮ বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা। তাজওয়ার মো. আউয়াল, মাল্টিমোড লিমিটেড, অ্যাংকর টাওয়ার, ১০৮ বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা। মোগল ফরিদা ওয়াই, ৮০-৭২, তাইরন পিআই, জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক, ইউএসএ। শহিদ উল্লাহ, ২৩৫, স্যাডল রজি পেলস, দ্য উড ল্যান্ডস, টেক্সাস, ইউএসএ। চৌধুরী ফয়সাল, বাড়ি -২৩, রোড-২৩, ব্লক-বি, বনানী, ঢাকা। আহমাদ সামির, অ্যাপার্টমেন্ট-৪বি, ১৫ ইউনাইটেড নেশানস রোড, বারিধারা, ঢাকা। ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, ৫০ মহাখালী বা/এ, ঢাকা। মুসা বিন শমসের, ভেনাস ওভারসিজ কোং, হোল্ডিং ব্লক-আই, বনানী, ঢাকা। ফজলে এলাহী, ডাইনামিক এনার্জি, হোল্ডিং বাড়ি -৪২৪, রোড -০৭, বারিধারা ডিওএইচএস, ঢাকা। কেএইচ আসাদুল ইসলাম, ইন্ট্রিপিড গ্রুপ, ধানমন্ডি, ঢাকা।

জুলফিকার আহমেদ, খালেদা শিপিং কোম্পানি, বাড়ি -১৩২, রোড -০৫, ধানমন্ডি আ/এ, ঢাকা। তাজুল ইসলাম তাজুল, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ। মোহাম্মদ মালেক, বেঙ্গল শিপিং লাইনস, ১০১ আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম। ইমরান রহমান, ওসান আইস শিপিং কোম্পানি, ইপিজেড, ঢাকা। মোহাম্মদ এ আউয়াল, শামস শিপিং লিমিটেড, ৭৭, মাওলানা শওকত আলী রোড, লালখান, চট্টগ্রাম। এরিক জনসন আনড্রেস উইলসন, ডব্লিউএমজি লিমিটেড বাড়ি-১৪, রোড-১৩, সেক্টর-৪, উত্তরা, ঢাকা। ফারহান ইয়াকুবুর রহমান, ইন্ট্রিডিপ গ্রুপ, বাড়ি ৫, রোড- ৫১, গুলশান, ঢাকা। তাজুল ইসলাম, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, বালুর মাঠ, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ। আমানুল্লাহ চাগলা, পদ্মা টেক্সটাইল, বাড়ি -৪৫৮, লেন-৮, ডিওএইচএস, বারিধারা ঢাকা। মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান, নিউটেকনোলজি ইনভেস্টমেন্ট, মস্কো, রাশিয়া। মোহাম্মদ রেজাউল হক, মাল্টা। মোহাম্মদ কামাল ভুইয়া, তুহিন-সুমন, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, বালুর মাঠ, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ। মাহতাবা রহমান, সেলকন শিপিং কোম্পানি, বাড়ি-৮৭, রোড-০৬, ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা। ফারুক পালওয়ান, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নারায়ণগঞ্জ। মাহমুদ হোসাইন, গ্লোবাল এডুকেশন সিস্টেম, আয়ারল্যান্ড। শাহনাজ হুদা রাজ্জাক, সাউদার্ন আইস শিপিং কোম্পানি, ঢাকা ইপিজেড।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, যারা অর্থপাচার করছেন, তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এদের ক্ষমতা অনেক বেশি। সব সময় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সরকারি সংস্থাগুলো এদের ধরতে সাহস পায় না। এদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে পাচারকারীদের বার্তা দেওয়া উচিত। কিন্তু এ ধরনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে না। যখন ইস্যুটি সামনে আসে, তখন চুনোপুঁটি কাউকে ধরা হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা নিরাপদেই থাকেন। তাই অর্থ পাচার রোধে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, পাচার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এরপর দুদকসহ দক্ষতা, সক্ষমতাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উচ্চবিত্তরা দেশে টাকা রাখে না। এটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। এ ধরনের কাজ আইনের আওতায় না এনে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এতে পাচার বাড়তে থাকবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ৫ কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। তাই অর্থ পাচার রোধে দুদকে আরো কঠোর ভুমিকা রাখতে হবে। 

দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, অর্থপাচারের বিষয়ে দুদকের কিছু করার নেই। মানি লন্ডারিংয়ের কাজটি এখন দুদকের না। অতিঅল্প একটউ কাজ যা ২৬ ভাগের একভাগ কাজ। মানি লন্ডারিংয়ের কাজটি সরকার আইন করে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে। তাই অর্থপাচার রোধে দুদকের সফলতা নেই বল্লেই চলে। তবে আমরা দুদক জুরিসডিকশন দেখব। যা আমাদের জুরিসডিকশনে নেই সেটাতে আমরা যাব না। ওই বদনাম যেন আমাদের ঘাড়ে না আসে। ২০১৫ সালে মুদ্রা পাচার আইন সংশোধন হলে সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া অন্যান্য ব্যক্তিদের অর্থপাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ হারায় দুদক।

তিনি জানান, প্রাইভেট ব্যক্তি মানি লন্ডারিং করে এবং ব্যাপক পরিমাণে মানি লন্ডারিং করে। হাজার হাজার কোটি টাকা না, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং হয়। আমরা কী করব? আমরা তো কিছু করতে পারিনি।

দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দুদক থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা থাকলেও আইনি কারণে সম্ভব নয়। পূর্বে মানি লন্ডারিং বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের। এখন এই সংক্রান্ত ২৮টি অপরাধের মধ্যে ২৭টিই চলে গেলে বিভিন্ন জায়গায়। একটি রয়ে গেছে দুদকের কাছে। 

তিনি জানান, ২০১৫ সালে মুদ্রা পাচার আইন সংশোধনের ফলে কেবল ঘুষ ও দুর্নীতি সংক্রান্ত সরকারি কর্মীদের অর্থ পাচার অপরাধের তদন্তের ভার দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে থাকল। এর আগে মুদ্রাপাচারের ঘটনা তদন্তের সার্বিক দায়িত্ব ছিল দুদকের ওপর। আইন সংশোধনের পর তা দুদকের পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ কাস্টমস ও কর বিভাগ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তদন্তের সুযোগ পায়। তবে বিদ্যমান আইনের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন ছোট-বড় সব দুর্নীতি সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে বলে দাবি করেন দুদক চেয়ারম্যান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads