• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

এখনো উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৪ জানুয়ারি ২০২২

দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আবারো জীবনযাত্রায় ফিরে এসেছে সরকার আরোপিত বিধিনিষেধ। কিন্তু সারা দেশে জারি হওয়া ১১ দফা বিধিনিষেধের সামান্যই কার্যকর হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এই নতুন বিধিনিষেধের প্রথম দিন রাস্তাঘাট, দোকানপাটে সাধারণ মানুষের ভিড় ছিল আগের মতোই। কোথাও মানা হয়নি সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি। ট্রেন ও লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল করলেও গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। অধিকাংশই মাস্ক না পড়ে দেন নানা অজুহাত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিংমলসহ সব প্রতিষ্ঠান চালু রেখে এই বিধিনিষেধ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে ডিএমপি, ডিএনসিসি, ঢাকা জেলা প্রশাসন নগরীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। স্বাস্থ্য বিধি না মানায় অভিযানের প্রথম দিনে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তবে ১১টি বিধিনিষেধের কথা বলা হলেও, গণপরিবহনে আসন সংখ্যার সমান যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে আগামীকাল শনিবার থেকে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। এর আগে গত সোমবার  বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রামপুরা মগবাজার কাকরাইল পল্টনসহ অন্যান্য এলাকায় বিভিন্ন যাত্রীবাহী বাসে স্বাস্থ্যবিধি তো দূরের কথা যাত্রীদের চাপে ভাড়া আদায়কারীর হিমশিম খেতে দেখা যায়। এমনকি টিসিব পণ্য ক্রয় করার জন্য রামপুরায় ছিল দীর্ঘ লাইন। সেখানেও অধিকাংশ লোকের দেখা যায়নি মাস্ক। রামপুরা টিভি সেন্টার থেকে কুড়িল বিশ্বরোডগামী ভিক্টর পরিবারের চালক মো. মোসলেম জানান, আসনের সমান সংখ্যক যাত্রী নেওয়ার এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলেই আমরা সেই অনুযায়ী চলবে। সায়েদাবাদ থেকে আব্দুল্লাহপুরগামী অনাবিল পরিবহনের ভাড়া আদায়কারী ব্যক্তি আব্দুল গনি জানান, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের নির্দেশনা এখনো পাইনি। তিনি বলেন, যাত্রীরা যেভাবে বাসে ওঠে, তাদের আটকানো যায় না। বাসের প্রবেশের দরজা বন্ধ রাখলেও কোনো কোনো সময় সেটা ভেঙে ওঠার চেষ্টা করে তারা।

এদিকে বাড্ডা, রামপুরা টিভি সেন্টার এলাকায় রাস্তায় টিসিবির পণ্য ক্রয়ের জন্য প্রায় কয়েকশ নারী-পুরুষ স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য ক্রয় করতে দেখা যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অধিকাংশ নারী-পুরুষের মুখে নেই মাস্ক। এছাড়া যারা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে পণ্য বিক্রি করছে তাদের অধিকাংশের মুখেও মাস্ক দেখা যায়নি।

টিসিবির পণ্য নিতে আসা এক নারী জানান, টিসিবিতে এত বড় লাইন চাল কিনতে পারবো কিনা এই চিন্তায় আছি। মাস্ক নিয়ে চিন্তা নেই। এদিকে রাজধানীর প্রায় এলাকায় দোকান-পাটে দেখা যায় স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছুই নেই। অধিকাংশ মানুষের মুখে নেই মাস্ক। নির্দেশনা না মানার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, সরকারের নির্দেশনা সম্পর্কে তারা জানেন না।

আগামীকাল শনিবার থেকে বাস ও ট্রেনে ৫০ শতাংশ আসন খালি রেখে যাত্রী পরিবহন করা হবে। এ যানবাহন সংশ্লিষ্ট চালক ও সহকারীদের করোনা টিকার সনদ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু টিকা নেননি বেশিরভাগ বাসের চালক-সহকারী, এমনকি মাস্কে ব্যবহারেও ও অনীহা।

কারওয়ান বাজারে নিউ ভিশনের চালক ইদ্রিস জানান, তিনি করোনার দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। তার কাছে টিকা নেওয়ার সনদও রয়েছে। তবে তার সহকারী মিজান এখনও টিকা নেননি। তবে মালিক টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে বলে তিনি জানান।

একই এলাকায় কথা হয় ইটিসি পরিবহনের একটি বাসের চালকের এক সহকারী হাবিবের সঙ্গে। হাবিব জানান, তিনি এখনও করোনার টিকা নেননি। স্বাধীন পরিবহনের একটি বাসের চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, দুজনের একজনও টিকা নেননি। মালিকপক্ষ থেকে তাদের জরুরি ভিত্তিতে টিকার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তারা।

শাহবাগে ট্রান্সসিলভা, মেঘলা, মালঞ্চ, বিআরটিসি, ওয়েলকাম, বিকল্প, খাজাবাবা, বসুমতি শিকড়সহ আরও কয়েকটি পরিবহনের বাসের চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই টিকা নেননি। ট্রান্সসিলভা পরিবহনের চালকের সহকারী ইমরান বলেন, টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করছি। কিন্তু মেসেজ নাই, যার জন্য টিকা নেওয়া হয়নি। শুনছি, কালকে থেকে আমাদের গণহারে টিকা দেওয়া হবে।

মালঞ্চ পরিবহনের চালকের সহকারী ইবাদত শাহবাগে মাস্ক ছাড়াই যাত্রীদের বাসে তোলার জন্য হাঁকডাক দিচ্ছিলেন। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইতে ইবাদত বলেন, মাস্ক হাত থেকে পড়ে গেছে। এখনো করোনার টিকা নেননি বলেও জানান ইবাদত। 

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, শনিবার থেকে গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। অবশ্য মালিক-শ্রমিক নেতারা বাসের চালক-শ্রমিকদের টিকার ব্যবস্থ্যা করে গাড়ি তাদের হাতে ছারবেন। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, যত আসন তত যাত্রী নিয়ে বাস চালাতে চান তারা। সব শ্রমিক যাতে টিকার আওতায় আসেন, সেটাতে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চালকের লাইসেন্স দেখিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে টিকা যাতে নিতে পারেন, সে বিষয়টি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেগুন বাগিচা এলাকায় হ্যান্ড মাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পুলিশের পক্ষ থেকে আহ্বান জানাতে দেখা যায়। যারা মাস্ক ছাড়া চলাচল করছে, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করেন পুলিশ সদস্যরা।

ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডা. সঞ্জীব দাস বলেন, বাসের যাত্রীরা মাস্ক পরে চলছেন কি না তা দেখেছি। এখনও অনেকে মাস্ক ছাড়া বের হচ্ছেন, কেউ মাস্ক পকেটে রাখছেন। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মৌখিকভাবে সতর্ক করা, মুচলেকা নেওয়া ও অপরাধ বিবেচনায় অর্থদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে বিধিনিষেধ কার্যকরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার প্রথম দিনে রাজধানীর শাহবাগে মাস্ক ছাড়া যাত্রী ও পথচারীদের সর্তক করার পাশাপাশি মুচলেকা দিয়ে ছাড়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অপরাধ বিবেচনায় সীমিত অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়েছে কয়েকজনকে।

শাহবাগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডা. সঞ্জীব দাস। দুপুর সোয়া ১২টা থেকে শুরু হওয়া অভিযানে গণপরিবহনে মাস্ক ছাড়া চলাচলকারী যাত্রী ও পথচারীদের মুচলেকা নেওয়া হয়েছে। এ সময় অপরাধ বিবেচনায় অর্থদণ্ডও দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট।

তিনি বলেন, প্রথম দিন হিসেবে আমরা মাস্ক ছাড়া চলাচলকারীদের সতর্ক করছি। কয়েকজনকে ১০০-২০০ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। বাসের যাত্রীরা মাস্ক পরে চলছেন কি না তা দেখছি। এখনো অনেকে মাস্ক ছাড়া বের হচ্ছেন, কেউ মাস্ক পকেটে রাখছেন। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মৌখিকভাবে সতর্ক করা, মুচলেকা নেওয়া ও অপরাধ বিবেচনায় অর্থদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।

সরকার ঘোষিত যে ১১টি বিধিনিষেধ মানতে হবে, সেগুলো হলো- দোকান, শপিংমল ও বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব জনসমাগমস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। অন্যথায় আইনানুগ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই করোনা টিকার সনদ প্রদর্শন করতে হবে। বারো বছরের ঊর্ধ্বের কোনো ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত তারিখের পরে টিকার সনদ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দরসমূহে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পোর্টসমূহে ক্রু-দের জাহাজের বাইরে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করতে হবে। স্থলবন্দরগুলোতেও দেশের বাইরে থেকে আসা ট্রাকের সঙ্গে শুধু ড্রাইভার থাকতে পারবে। কোনো সহকারী আসতে পারবে না। বিদেশগামীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। ট্রেন, বাস ও লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে। সর্বপ্রকার যানবাহনের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে কোভিড-১৯ টিকার সনদধারী হতে হবে। (ট্রেন-বাস অর্ধেক যাত্রী বহন করবে ১৫ জানুয়ারি থেকে, লঞ্চের তারিখ এখনো জানা যায়নি)। বিদেশ থেকে আগত যাত্রীসহ সবাইকে বাধ্যতামূলক কোভিড ১৯ টিকার সনদ প্রদর্শন এবং র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন এবং মাস্ক পরিধানের বিষয়ে দেশের সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। সর্বসাধারণের করোনার টিকা এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রচার ও উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সহায়তা গ্রহণ করবে। কোভিড আক্রান্তের হার ক্রমবর্ধমান হওয়ায় উন্মুক্ত স্থানে সর্বপ্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা সমাবেশসমূহ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে। কোনো এলাকার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads