• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নিম্ন ও মধ্যবিত্তে টানাপোড়েন

ফাইল ছবি

জাতীয়

নিম্ন ও মধ্যবিত্তে টানাপোড়েন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ জানুয়ারি ২০২২

দেশে করোনাকালে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। প্রায় দুই বছর ধরে দফায় দফায় লকডাউন ও বিধিনিষেধের ধাক্কায় বিপর্যস্ত বহু প্রতিষ্ঠান। এলোমেলো হয়ে গেছে লাখো মানুষের জীবন। একদিকে খেটে খাওয়া শ্রমিকের রোজগারে টান পড়ছে, অন্যদিকে বাইরে বের হলে সংক্রমণের ঝুঁকি-এ যেন উভয় সংকট। এরমধ্যে দফায় দফায় অস্বাভাবিক হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মাস শেষে বাসা ভাড়ার চাপ, যানবাহনে বাড়তি ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট-ডিশ বিলসহ নানা খরচে আয়-ব্যয়ের সমন্বয় হচ্ছে না তাদের। অনেকে ন্যূনতম চিকিৎসা খরচটাও মেটাতে পারছে। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ২০২০ সালের মার্চে প্রথম লকডাউন দিয়ে টানা ৬৬ দিন সবধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল। এরপর গত বছরের শুরু দিকে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় বিধিনিষেধসহ লকডাউন। তারপর ধাপে ধাপে বাড়ানো হয় এটি। এরমধ্যে কয়েকবার বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিলও করা হয়। ১৪ জুলাই পর্যন্ত লকডাউন চলার পর কোরবানির ঈদে পশুর হাটে বেচাবিক্রি ও ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে আট দিনের জন্য শিথিল করা হয় লকডাউন। কোরবানির ছুটি শেষে ২৩ জুলাই থেকে আবার শুরু হয় কঠোর বিধিনিষেধ, যা শেষ হয় ১০ আগস্ট দিবাগত মধ্যরাতে। এরপর থেকে কঠোর বিধিনিষেধ বা লকডাউন থাকায় গত ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সবকিছু সচল থাকে। এতে মানুষের জীবনমান কিছুটা ফিরতে থাকে। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি)  থেকে অনির্দিষ্টি কালের জন্য চতুর্থবারের মতো ১১ দফার বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। তবে করোনা সংক্রামণ পরিস্থিতি অবনতি হলে আগামীতে লকডাউনসহ কঠোর বিধিনিষিধও আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।  

এদিকে করোনাকালিন বিধিনিষেধ জীবন এবং জীবিকা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্তর সামনে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবিকার সন্ধানে থাকা মানুষগুলো আজ অপ্রিয় অথচ কঠিন সত্যের মুখোমুখি। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে থাকা মানুষগুলোর জীবনের জীবিকা রক্ষাও এখন বড়ো ব্রত। গত দুই বছর যাবত ঢাকা শহরের অনেক পরিপাটি বাড়িগুলোতে ঝুলছে টু-লেট লেখা সাইনবোর্ড। পাড়ার মোড়ের দেয়ালগুলো বছরজুড়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ছেয়ে থাকে অথচ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে টু-লেট, সাবলেট অগণিত বিজ্ঞাপন।

ভিন্ন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দৃঢ় মমতায় বেড়ে ওঠা এ শহরে মানুষগুলো যে শুধুমাত্র করোনার ভয়েই শহর ছাড়ছে তা কিন্তু নয়; বরং কর্মহীন এই মানুষগুলো হারাচ্ছে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। অল্প উপার্জনের মধ্যবিত্ত পরিবারটি কীভাবে তাদের বাড়ি ভাড়া মেটাবে, নেই সেই নিশ্চয়তা। এ ছাড়া গলার কাঁটা হিসেবে যোগ হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল। আবার বাড়ির মালিকও রয়েছে বিপদে। ব্যাংক ঋণে গড়া বাড়ি, তাকেও তো বকেয়া মেটাতে হয় মাস শেষে। তাই মানুষ ক্রমশ দরিদ্র হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর জরিপে দেখা গেছে, লকডাউন ও বিধিনিষেধের কবলে পরে ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হরিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, ৩২ দশমিক ১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩ দশমিক ২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭ দশমকি ২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯ দশমকি ৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এই জরিপে মধ্যবিত্তের ওপর করোনার অভিঘাত স্পষ্ট।

বিআইডিএস-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে বেসরকারি খাতের চাকরির আয় এরই মধ্যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই। আবার কারো বেতন কমে গেছে। এসএমই সেক্টরে ধস নেমেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণা বলছে, গত বছর বিধিনিষেধ ও লকডাউনে (৫ এপ্রিল থেকে ১০ আগস্ট, ২০২১ পর্যন্ত) চাকরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৭ শতাংশ শ্রমিকের। সবচেয়ে বেশি পরিবহন খাতের শ্রমিকদের ৯৫ শতাংশ, দোকানপাট শ্রমিকদের ৮৩ শতাংশ এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের ৮২ শতাংশ কর্মসংস্থান হারান। লকডাউন পরবর্তী সময়ে ৯৩ শতাংশ শ্রমিক চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছেন, ৭ শতাংশ শ্রমিক এখনো বেকার রয়েছেন। তবে লকডাউন সময়ে এসব খাতে খণ্ডকালীন শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বেড়েছিল ২১৫ শতাংশ। অন্যদিকে লকডাউনে তিনটি খাতে কার্যদিবস কমেছিল ৭৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৯২ শতাংশ কার্য দিবস কমেছে পরিবহন খাতে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে অবশ্য কাজের চাপ বেড়েছে, কার্যদিবস এবং কর্মঘণ্টা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউনে তিনটি খাতের শ্রমিকদের আয় গড়ে ৮১ শতাংশ কমেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবহন খাতের শ্রমিকদের ৯৬ শতাংশ এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। যেখানে লকডাউনের আগে মাসিক গড় আয় ছিল ১৩ হাজার ৫৭৮ টাকা, সেটা লকডাউন সময়ে নেমে এসেছিল ২ হাজার ৫২৪ টাকায় এবং লকডাউন পরবর্তী সময়ে আয় দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৫২৯ টাকা। অর্থাৎ লকডাউন পরবর্তী সময়েও ৮ শতাংশ আয়ের ঘাটতি থাকছে।

লকডাউনে শ্রমিকদের পরিবারে আয় এবং ব্যয়ের ঘাটতি ছিল প্রায় ৭৭ শতাংশ, সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশ পরিবহন খাতের এবং সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ রয়েছে খুচরা দোকান বিক্রেতা খাতের শ্রমিক পরিবারের। ২০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার সম্পত্তি বিক্রয়, খাবার কমিয়ে দেওয়া এবং সন্তানদের কাজে পাঠানোর মাধ্যমে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেছেন। এছাড়া ৮০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার ধার করে এবং সঞ্চয় কমিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করছেন। লকাডাউন পরবর্তী সময়ে সঞ্চয় কমেছে ৬৪ শতাংশ এবং সঞ্চয়কারীর সংখ্যা কমেছে ৫০ শতাংশ।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের জরিপ বলছে, করোনাকালীন লকডাউন ও বিধিনিষেধে সঞ্চয় ভেঙেছে নিম্নআয়ের ২১ শতাংশ পরিবার। এরা হলেন বস্তি, হাওর, দলিত ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ। যাদের একটি বড় অংশই এখনো ফিরতে পারেনি আগের অবস্থায়; বরং বেড়েছে কাজ নিয়ে অনিশ্চয়তা। এছাড়া এ সময়ে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল দেশের প্রায় ৭৯ শতাংশ পরিবার।

প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে রাজধানীর করাইল বস্তিতে ঠিকানা হয় সওদাগরের। এরপর মোড়ে মোড়ে ভেলপুরি বিক্রি করে চালাতেন চার জনের সংসার। ইচ্ছে ছিল কিছু টাকা জমিয়ে গ্রামে বানাবেন নিজের বাড়ি। তবে অতিমারিকালে ভেঙে যায় তার সব স্বপ্ন। প্রায় অর্ধযুগ ধরে ঢাকার বুকে বাস করা হেলেনার গল্পটাও অনেকটা এমনই। পার্থক্য শুধু করোনায় কাজ হারিয়ে এখনো আছেন অকূল পাথারে।

প্রায় ১৬শ পরিবারের ওপর নাগরিক প্ল্যাটফরম পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বস্তি, হাওর, দলিত ও প্রান্তিক গোষ্ঠির প্রায় ২১ শতাংশই করোনাকালে তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। বিকল্পপন্থা হিসেবে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ পরিবার।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের এখানে প্রথম দিকে করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল। এখন অনেকটা কেটে গেছে। খোলা-বন্ধ এই প্রক্রিয়া সব দেশই অনুসরণ করেছে। আমরাও করছি। এরমধ্যে আবার করোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। এটি বড় চিন্তার বিষয়।

তিনি বলেন, কোন দুর্যোগ মোকাবিলা করতে গেলে, জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় আনতে গেলে সব সময়ই সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা বড় চ্যালেঞ্জ। যেমন গত দুই বছর লকডাউন ও বিধিনিষেধে অন্যান্য খাতের চেয়ে সেবা খাতের সঙ্গে জড়িত (নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা) মানুষগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম তাদের অস্থায়ী আর্থিক সহায়তা হিসেবে কর্মহীন পরিবারকে মাসে দুই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হোক। সরকার করেনি। তারা সনাতনী কায়দায় পুরোনো দরিদ্রদের সহায়তা করছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায়। কিন্তু নতুন দরিদ্রদের জন্য কিছু করেনি। এদের মধ্যে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ আছেন, হকার, নির্মাণশ্রমিক আছেন, হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক আছেন। দুই হাজার টাকা করে এক কোটি পরিবারকে ১২ মাস নগদ সহায়তা দিলে খরচ হতো ২৪ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। সেটি করতেও সরকার রাজি হয়নি।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগামীতে যদি বিধিনিষেধ আসে তা হলে এর কারণে যারা অর্থকষ্টে ভুগছেন বা ভুগবেন, সরাকারের তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। সরকারের উচিত কাজ হারানো হতদরিদ্র মানুষের কাছে চাল, ডাল, লবণ, তেলসহ নিত্য পণ্যগুলো পৌঁছে দেওয়া। একই সঙ্গে যারা কর্মহীন হয়ে দীর্ঘদিন বেকার, তাদের কর্মসংস্থান করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ও ‘উন্নয়ন অন্বেষণের’ চেয়ারপার্সন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, আবার জনজীবনে বিধিনিষেধ চলে আসাটাই চিন্তার বিষয়। এটা কঠোর বা দীর্ঘ হলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা মহাবিপদে পারবেন। যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের আপাতত কোনো সংকট হবে না।  কিন্তু যারা বেসরকারি খাতে আছেন তারা এখন জমানো টাকা আগেই খাওয়া শেষ করেছেন। বিগত কয়েক মাস কাজ করে পূর্বের ঋণ দেওয়া ও নিজেদের দৈনন্দিন ব্যায় মিটিয়ে সঞ্চয়ের সুযোগ হয়নি তাদের। তাই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে যাবেন অনেকেই। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনামিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, অতিমারিকালে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। গতবছরের লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণিটি ছিল মধ্যবিত্ত। ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পরিবার আছে। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ এই তিন শ্রেণির মধ্যবিত্ত। সংখ্যায় এ শ্রেণিতে প্রায় আড়াই কোটি পরিবার আর দশ কোটি মানুষ আছে। চক্ষুলজ্জার কারণে এদের বেশিরভাগই মানুষের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চাইতে পারে না, পারে না ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে। তাই এখন দেশে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে আছেন নিম্ন মধ্যবিত্তরা। আয় কমে গেলেই তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চলমান বিধিনিষেধের ব্যাপারে সরকারের আগাম পরিকল্পনা করেই সামনে চলার পরামর্শ দিলেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads