• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

৩৫ কোটির মধ্যে ছাপা হয়েছে ২০ কোটি বই

এনসিটিবির টেন্ডার নিয়ে ভাগবাঁটোয়ারা

  • প্রকাশিত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

রতন বালো

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) টেন্ডার নিয়ে চলছে ভাগ-বাটোয়ারা। তাই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক কম দরে টেন্ডার জমা দেওয়ার কারণে দুই দফায় পুনঃটেন্ডার আহ্বান করা হয়। এরপরও বেশি দরের টেন্ডার কোনো প্রেস মালিককে জমা দিতে দেয়নি একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে, এনসিটিবিকে জিম্মি করে কম দরের টেন্ডার জমা দিয়ে তা ভাগ-বাটোয়ারা করেছে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির ওই প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এই সমিতির একশ্রেণির কর্মকর্তা প্রেস মালিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে বিনামূল্যের পাঠ্যবই প্রকাশের কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে। পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০ কপি পাঠ্যপুস্তকও ছাপানো সম্ভব হয়নি। অথচ গত ১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এখনো বই বিতরণ করা হয়নি।

করোনা মহামারির কারণে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। তারা পিডিএফ (অনলাইনে) ফাইল শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বছরের বই দেওয়া সম্ভব হয়নি। শিক্ষার্থীরাও বাসায় বসে নতুন শিক্ষাবর্ষের বই পড়তে পারছে না। ফলে সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। রাজধানীর সরকারি রুপনগর মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, মনিকানন উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুর উপশহর  (সকাল/বিকেল) প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেওয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে, গুরুতর অভিযোগ উঠেছে এনসিটিবির একশ্রেণির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তারা খাতাপত্রে দেখাচ্ছেন নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে সরকারি রুপনগর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক মো. জাহিদ বলেন, আমরা যখন সরকারি বই পাচ্ছি, তখনই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছি। চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দেওয়ার। শিক্ষার্থীদের হাতে বই নেই কিভাবে অনলাইনে  আপনারা ক্লাস নিচ্ছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিডিএফ ডাউনলোড করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ১৩ টি বই দেওয়ার কথা, কিন্তু দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪ টি বই। এই হলো রাজধানীর ক্ষুদ্র একটি এলাকার চিত্র।

আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি নুরুল আজিজ চৌধুরী জানান, নারায়ণগঞ্জের পাঁচ উপজেলায় বই বিতরণ করা হলেও ২ উপজেলার ৩২৬টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে এখনো সব নতুন পাঠ্যবই পৌঁছায়নি। বছরের প্রায় দেড় মাস পার হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই না পৌঁছায় হতাশা বিরাজ করছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে।

এনসিটিবি বলছেন, নির্ধারিত ছাপাখানা থেকে গত ডিসেম্বরেই বই সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বই সরবরাহ করা হয়নি। বন্দর কদম রসুল শিশুবাগ স্কুলের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার। সে নতুন বই পায়নি। কবে বই দেবে, তাও স্কুল থেকে তাকে জানানো হয়নি। স্কুল থেকে পুরোনো বই দেওয়া হয়েছে। সেই বই দিয়েই পড়াশোনা করছে।

নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দর উপজেলায় মোট ১৯৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৩০টি বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ৩৪ হাজার ৭০০ শিক্ষার্থীর জন্য ২ লাখ ৮ হাজার ২১২টি বই বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এনসিটিবির কাছ থেকে এই দুই উপজেলার বই ছাপানোর দায়িত্ব পেয়েছে বন্দরের নবীগঞ্জে অবস্থিত জাহানারা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন। তারা বই ছাপানোর পর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠালে সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু গত দুই মাসে ছাপাখানা থেকে পঞ্চম শ্রেণির কোনো বই সরবরাহ করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সোহাগ হোসেন বলেন, ছাপাখানা থেকে বই না দেওয়ায় ৭৫টি প্রাথমিক ও ৭০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৫ হাজার শিক্ষার্থী এখনো বই পায়নি। ছাপাখানায় বারবার যোগাযোগ করলেও বই সরবরাহ করেনি তারা। 

নারায়নগঞ্জ সদর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মুক্তা বেগম বলেন, সদরের ১২০টি প্রাথমিক ও ৬০টি কিন্ডারগার্টেনের পঞ্চম শ্রেণির ২৫ হাজার শিক্ষার্থী এখনো বই পায়নি। বাফার স্টক থেকে সাড়ে তিন হাজার সেট বই এসেছে। আপাতত সেগুলো দেওয়া হবে। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, বিষয়টি সমাধানের জন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। ইতিমধ্যে কিছু বই চলে এসেছে। বাকি বইও দ্রুত চলে আসবে বলে জেলা প্রশাসক জানান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের  মোট ৩৪  কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০ কপি পাঠ্যবই ছাপানোর কথা। গতকাল শনিবার পর্যন্ত মাত্র ২০ কোটি ছাপা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বাকি বইগুলো প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই বলে অভিজ্ঞ প্রেস মালিকদের অভিযোগ। তারা বলেছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ ছাপার কাজ শেষ করতে চলতি ফেব্রুয়ারি মাস লেগে যেতে পারে।

এ বিষয়ে বিিমল্লাহ প্রিন্টিং প্রেসের মালিক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ প্রিন্টিং প্রেসের মালিক মো. আমিরুজ্জামান লাবলুর সঙ্গে আমার নেগোসিয়েশন হয়েছে। আমাকে একটা প্যাকেজের মাধ্যমে কাজ দেবে। ১৬ লাখ টাকা রেডি করতে বলেছেন। তারপরও কোনো প্যাকেজ দেওয়া হয়নি। এনসিটিবির টেন্ডার নিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করছে মুদ্রণ শিল্প সমিতি। যারা কাজ পায়নি তারাই মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানালেন তাজুল ইসলাম। এভাবে কাজ করার কারণে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে।

এ সম্পর্কে মো. আমিরুজ্জামান লাবলু বলেন, দ্বিতীয় টেন্ডার হয়েছে। তার পরেও প্রথম অবস্থায় চেষ্টা করেছিলাম। টেন্ডার জমা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের ৫-৭ জন লোক বেইমানি করেছেন। বেশি দরের টেন্ডার কম দরে জমা দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে এনসিটিবি কম দরে টেন্ডার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে মামলা করে কোনো লাভ হবে না বলে আমিরুজ্জামান লাবলু জানান।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সহ-সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। তবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জহুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের মুদ্রণ শিল্প সমিতি সম্পর্কে যে যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। ক্যাপাসিটির বাইরে আমরা কাজ করি না। কাউকে কাজও দিতে পানি নাই বলে তিনি জানান। প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় টেন্ডার জমা দেওয়ার বিষয়ে এনসিটিবির বাইরে কিছু বলতে পারবো না। একটি মামলা কেন, দশ টা মামলা করুক  তাতে কোনো লাভ হবে না।  তিনি জোর দিয়ে বলেন, এনসিটিবির নিয়ম মেনেই সব কাজ হয়েছে।  এভাবেই নিজের কথা বললেন  জহুরুল ইসলাম।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি সৈয়দ সেরনিয়াবাত বলেন, টেন্ডার নিয়ে যারা বলেছেন, টেন্ডার সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা নেই। যারা বলছেন, সব ভুল বলেছেন। ঠিক বলেননি। দ্বিতীয় টেন্ডারে যে কাজ হচ্ছে তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। সমঝোতার মাধ্যমে অধিক মূল্যে কাজ পায়। যারা ভাগ-বাটোয়ারা সম্পর্কে বলছেন, তা ঠিক নয়।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, গতকালের আপডেড তথ্য আমার কাছে নেই। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত  যে তথ্য ছিল তা হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি বই ছাপা সম্পন্ন হয়েছে।  জেলা উপজেলায়  পৌঁছানো হয়েছে ৮ কোটি বই। বাকি বই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছে দিয়েছি। প্রতি বছরের মতো এবারো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঠ্যপুস্তক উৎসব উদ্বোধন করেছেন।

পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিতে পুনঃদরপত্র আহ্বান করায় মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার কাজ শুরু করতে দেরি হয়। অপরদিকে প্রাথমিকের অর্ধেকের বেশি বই ছাপার কাজ দেওয়া হয় একটি প্রতিষ্ঠানকে। গত বছর ওই প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত সময়ের দুই মাস পরও শতভাগ বই দিতে পারেনি। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ  দেওয়ার জন্য দরপত্রের মাঝখানে হঠাৎ সংশোধনীও আনে এনসিটিবি।

জানা  গেছে, প্রতিবছর  সেপ্টেম্বরের মধ্যে ছাপাখানাগুলোর সঙ্গে চুক্তি হলেও এবার তৃতীয়  থেকে পঞ্চম  শ্রেণির বই ছাপাতে চুক্তি হয় ১৮ অক্টোবর। প্রথম ও দ্বিতীয়  শ্রেণির জন্য চুক্তি হয় ২৪ অক্টোবর। স্কুলের বই ছাপতে সাধারণত তিন মাস সময় পায় ছাপাখানাগুলো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads