• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বাজার সয়লাব পলিথিনে

এখনো অধরা সোনালি ব্যাগ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০২২

পরিবেশবান্ধব ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ছয় বছর আগে। পাট থেকে তৈরি এই পলিথিন ব্যাগের নাম দেওয়া হয় ‘সোনালি ব্যাগ’। উদ্ভাবনের পর ছয় বছর পেরিয়েছে, এখনো বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসেনি এই ব্যাগ। এর মধে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ব্যাগের সীমিত উৎপাদন সম্ভব হয়েছে কেবল। এই অবস্থায় প্রকল্পের সময় আরো এক বছর বাড়ানো হয়; সে মেয়াদও শেষ হয়েছে এক বছর আগে।

কিন্তু সোনালি ব্যাগ বাজারে আসবে কবে? আদৌ কি তা আসবে? এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) কোনো কর্মকর্তা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার পালিত হয়েছে জাতীয় পাট দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ’।

নির্ভরযোগ্য বিকল্পের অভাবে বাজার সয়লাব নিষিদ্ধ পলিথিনে। মাঝে হাতে ঝুলিয়ে ব্যবহার উপযোগী পলিথিন ব্যাগ বন্ধ ছিল। এখন সেই ব্যাগও বাজারে ফেরত এসেছে। কাঁচাবাজার, মুদি দোকান, শপিংমল, চেইন শপ সব জায়গায় পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পণ্য নিয়ন্ত্রণে মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হয়, কিন্তু তাতে পলিথিনের ব্যবহার কমেনি।

বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। পরিবেশবিদরা বলছেন, আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণেই পলিথিন থেকে মুক্তি মিলছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পলিথিন নিয়ে চিন্তিত সারা বিশ্ব। প্রতিদিন লাখ লাখ টন পলিব্যাগ ব্যবহূত হচ্ছে, বর্জ্য হিসেবে তা পরিবেশ দূষণ করছে।

পাট থেকে পলিথিন তৈরির উদ্ভাবক মোবারক আহমেদ খান ও তার তৈরি পলিথিন সোনালি ব্যাগ। এই পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের জন্যই ক্ষতিকর পলিথিনের নির্ভরযোগ্য বিকল্প ভাবা হয়েছিল পাটের তৈরি পচনশীল সোনালি ব্যাগকে। এটি উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমেদ খান, ২০১৬ সালে। এটি একটি সেলুলোজভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক, যা প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প। পাট থেকে সেলুলোজ সংগ্রহ করে তা দিয়ে এ ব্যাগ তৈরি করা হয়। এটি দেখতে সাধারণ পলিথিনের মতোই, তবে তা পচনশীল। বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসার আগেই ‘সোনালি ব্যাগ’ দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলেছিল। ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সেই ব্যাগ ছয় বছরেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি।

ঢাকার ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে সরকারি পাটকল লতিফ বাওয়ানী জুট মিল। সেখানেই সোনালি ব্যাগ তৈরির কারখানা। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। ওই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়েছে। বর্তমানে হাজারখানেক সোনালি ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিটি ব্যাগ ১০ টাকা দামে শুধু মতিঝিলে অবস্থিত বিজেএমসির কার্যালয় থেকে কেনা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন দূতাবাসে নমুনা হিসেবে পাঠানো হয় এ ব্যাগ।

চার বছর আগে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান জানিয়েছিলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি খুব দ্রুতই এ ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবেন। কিন্তু সেই পৃষ্ঠপোষকতা মেলেনি, তাই বাজারজাত করাও সম্ভব হচ্ছে না। উদ্ভাবক মোবারক আহমেদ এখন বলছেন, সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে আরো ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। সরকারের কাছে এই টাকা চেয়ে আবেদনও করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাও খুঁজছেন তিনি। বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ বাজারে আনার ক্ষেত্রে মূল জটিলতা এখন একটি স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) ব্যাগ সিলিং মেশিন কেনা; আর দরকার বড় আকারের অর্থায়ন। মোবারক আহমেদ খান বলেন, ‘পাইলট প্রকল্পে টার্গেট ছিল এক লাখ ব্যাগ উৎপাদন করা। তা সম্ভব হয়নি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ব্যাগ সিলিং মেশিনের অভাবে। এখন ২৪ ঘণ্টা যন্ত্র চালিয়ে ৯০ হাজার ব্যাগ উৎপাদন করা যায়। বেসরকারি উদ্যোক্তারা যদি বিনিয়োগ করেন, তাহলে এটা আরো দ্রুত বাণিজ্যিক আকারে করা সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, এই ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনার জন্য যা যা করা লাগে, সরকারি অর্থায়ন থেকে শুরু করে বেসরকারি উদ্যোক্তা কোনো কিছুতেই বাধা নেই। আমরা এখন সেমি আকারে (মাঝারি) বাজারজাত করার জন্য ১৫ থেকে ২০ টন উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। আর এ জন্যই প্রয়োজন ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। জানতে চাইলে এই বিজ্ঞানী বলেন, চাওয়া হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। সরকারও বুঝেছে, বিদেশে সোনালি ব্যাগের চাহিদা অনেক। কিন্তু কেন টাকাটা দিচ্ছে না, সেটাই বুঝতে পারছি না।

তিনি আরো বলেন, বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ বাজারে আনার জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) ব্যাগ সিলিং মেশিন কেনার জন্য চীনে অর্ডার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা আসলেই হবে না, পুরোদমে উৎপাদনের জন্য আরো অর্থের প্রয়োজন। আমার এখন মনে হচ্ছে, বেসরকারি খাত বিনিয়োগ না করলে সোনালি ব্যাগ বাজারে আনা কঠিন হয়ে পড়বে।  আমরা যদি বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে এই ব্যাগ উৎপাদন করতে পারতাম, তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে তৈরি পোশাকের মতো বিশ্ববাজারের বড় বাজার দখল করতে পারতাম। এদিকে সবাই কেন মনোযোগ দিচ্ছে না, সেটাই আমি বুঝতে পারছি না।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শেওড়াপড়া, শান্তিনগর বাজার, হাতিরপুল বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাটজাত মোড়কের বদলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বস্তায় আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, আদা, রসুন বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে কিছু চালের দোকানে পাটের বস্তা ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

২০০২ সালে দেশে পলিথিন নিষিদ্ধের পর বিকল্প হিসেবে সে সময় কাগজের ঠোঙার ব্যবহার কিছুটা বেড়েছিল। কিন্তু পলিথিনের চাপে টিকতে পারেনি কাগজের ঠোঙাও। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ২০ বছর ধরে পলিথিন দূষণ নিয়ে চিন্তিত।

‘প্লাস্টিক পলিউশন প্রিমিয়ার অ্যান্ড অ্যাকশন টুলকিট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭ লাখ ৯০ হাজার টন পলিথিন বর্জ্য জমা হয়। বাংলাদেশে একজন মানুষ দৈনিক ৪৩০ গ্রাম বর্জ্য তৈরি করে থাকে। এর মধ্যে ৮ শতাংশ তথা প্রায় ৩৫ গ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্য। অর্থাৎ বছরে একজন মানুষ প্রায় ১৩ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে।

২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে আবারো উদ্যোগ নেয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সে বছর ও ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ধান, চাল, ভুট্টা, সার, চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন কিছু অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু জনবল ও তদারকির অভাবে অভিযানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। ফলে সরকারের সে উদ্যোগের সুফল আর মেলেনি।

পলিথিন বন্ধে ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৮৭১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে মামলা করে ১০৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২০ কোটি ৬০ লাখ ৯৩ হাজার ৬৮০ টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানগুলোতে ১ হাজার ২৩৬ টন পলিথিন ও প্লাস্টিকের দানা জব্দ করা হয়।

২০২০ সালের শুরুতে উচ্চ আদালত পলিথিন এবং একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দেন। ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। অধিদপ্তর আরো কিছুদিন সময় চেয়ে নেয় এবং ১০ ফেব্রুয়ারি তা আদালতে জমা দেয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) ১১টি সংগঠনের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি আদালত ওই আদেশ দেয়।

পলিথিন ঠেকাতে করণীয় জানতে চাইলে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, লোক দেখানো ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করলে লাভ হবে না। নিয়মিত বাজার তদারকি, পলিথিনের বিকল্প বাজারে আনা, আইনের নিয়মিত প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করা এই চার পদক্ষেপ দিয়েই পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব। পাশাপাশি মানুষকে বোঝাতে হবে, পলিথিনের ক্ষতি কতটা গভীর।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads