• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

শ্রম সেক্টরে চলছে নীরব বিপ্লব

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০২২

রতন বালো :

 

সারা দেশে শ্রম ও কর্মসংস্থানে নীরব বিপ্লব ঘটতে চলেছে। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বহুমুখী পরিকল্পনার পাশাপাশি শ্রম খাতকে গতিশীল করতে সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। বাড়ানো হয়েছে শ্রমিকদের মজুরি, নির্ধারণ করা হয়েছে তাদের কর্মঘণ্টা। সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোয় শ্রমিকরা বর্তমানে অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল যা অতীতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাদের উর্পাজনের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোয় তারা এখন অধিক পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে। এসবই সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে। শ্রমিকবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৯ সাল থেকে গত দশ বছরে শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ১ হাজার ৬৬২ টাকা থেকে তিনবারে মোট ৩৮০ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে।

এছাড়া শিশু শ্রম নিরসন নীতিমালা-২০১০, বাংলাদেশ শ্রম নীতিমালা-২০১২, বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন-২০১৩ এবং ২০১৮, জাতীয়  পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি (ওএসএইচ) নীতিমালা-২০১৩, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ প্রণয়ন করা যা শ্রমবাজারে অনেকটাই বিপ্লব ঘটিয়েছে। এদিকে বর্তমান সরকারের শাসনামলে খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার সুরক্ষা এবং তাদের কল্যাণসাধনে কাজ করছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গত দুই বছর করোনা মহামারির মধ্যে শ্রম সেক্টরে ভাটা পড়লেও আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি এবং স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বের ১০টি গ্রিন ফ্যাক্টরির (সবুজ কারখানা) মধ্যে বাংলাদেশেরই ৭টি। নতুন যত গার্মেন্টস কারখানা তৈরি হচ্ছে সবগুলোই অত্যাধুনিক কারখানা। বর্তমানে এক শর বেশি গ্রিন ফ্যাক্টরির দেশ বাংলাদেশ।

ইতোমধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে সকল কারখানাগুলোকে পরিদর্শনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোলমডেল বলে মনে করছেন শ্রম বিশেষজ্ঞরা। গত দুদিন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধান এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলামের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

শ্রম আইন এবং ট্রেড ইউনিয়ন : বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬কে ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে সংশোধন করে যুগোপযোগী  ও শ্রমিকদের সেবাপ্রাপ্তি সহজকরণে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন সহজিকরণ করা হয়েছে। আগে যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন পেতে ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন প্রয়োজন হতো এখন ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থনেই শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারছেন। ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধনের আগে তৈরি পোশাক শিল্পে যেখানে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ৮২টি বর্তমানে সেখানে ৮৮২। আর সব সেক্টর মিলে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৮ হাজার ৩৪। আর জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন সংখ্যা ৩২টি।

শ্রম পরিদর্শন এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি : কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের জনবল বৃদ্ধি ও সব ধরনের শিল্প খাতকে শ্রম পরিদর্শনের আওতায় আনার জন্য এ অধিদপ্তরের পরিদর্শকের সংখ্যা আরো বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পরিদর্শন ব্যবস্থাকে অনলাইন সিস্টেমে আনা হয়েছে, প্রতিটি পোশাক কারখানায় সেইফটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় চতুর্থ বারের মতো এবছরও জাতীয়ভাবে ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস’ পালন করেছে। দিনে দিনে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহীতে পাঁচ একর জমির ওপর নিজস্ব জায়গায় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি ইনস্টিটিউট নির্মাণ করছে।

শ্রমিকদের কল্যাণে : শ্রমিকদের অধিকার এবং তাদের সেবা নিশ্চিতকরণে মন্ত্রণালয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরকে একই ভবনে নিয়ে আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এ লক্ষ্যে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় ২৫তলা শ্রম ভবন চালু করা হয়েছে। এছাড়া ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর  এবং চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় নারী শ্রমিকদের আবাসন সুবিধা প্রদানের জন্য সতের শ আসনের ডরমেটরি (আবাসিক হল) নির্মাণ কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব জায়গায় শ্রমঘন এলাকায় মহিলা শ্রমিকদের জন্য হোস্টেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন : ২০২৫ সালের মধ্যে সবধরনের শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।  এক্ষেত্রে ৩৮টি কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তৈরি পোশাক এবং চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পকে শিশুশ্রম মুক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই আরো ১১টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেমন অ্যালুমিনিয়াম, তামাক/বিড়ি, সাবান, প্লাস্টিক, কাঁচ, পাথরভাঙ্গা, সিল্ক, ট্যানারি, জাহাজভাঙ্গা এবং তাঁত শিল্পকে শিশুশ্রম মুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। 

বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন : বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের কল্যাণে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল। বছর শেষে দেশি-বিদেশি কোম্পানির লাভের ৫ শতাংশের এক দশমাংশ এ তহবিলে অর্থ জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৬০টি কোম্পানি নিয়মিত এ তহবিলে অর্থ জমা দিচ্ছে। এ তহবিলে লভ্যাংশের নিদিষ্ট অংশ জমা প্রদানের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি বরাবরে আবারো তাগিদপত্র  প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমানে এ তহবিলে জমার পরিমাণ প্রায় চার-শ কোটি টাকারও বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে এবং শ্রমিকের সন্তানের উচ্চ শিক্ষায় সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়তা প্রদান করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই শিক্ষা সহায়তা চালু হয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৮৬৬ জন শ্রমিকের মেধাবী সন্তানকে শিক্ষা সহায়তাসহ এ তহবিল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ হাজার অসহায় শ্রমিক এবং তাদের স্বজনদেরকে  এপর্যন্ত ৩২ কোটি টাকার ওপরে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় তহবিল : গার্মেন্টস শিল্পের ৪০/৪২ লাখ শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য ‘কেন্দ্রীয় তহবিল’ গঠন  শ্রমিকবান্ধব এ সরকারের একটি ঐতিহাসক সাফল্য। শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের মোট রপ্তানির ০.০৩ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি এ তহবিলে জমা হয়। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে এ তহবিল কার্যকর হয়েছে। বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ-এর মাধ্যমে গার্মেন্টস শ্রমিকদের শতভাগ বীমা দাবি এবং গার্মেন্টস মালিকদের আপদকালীন সময়ে এ তহবিল থেকে প্রদান করা হয়।

এছাড়া কোনো গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মস্থলে এবং কর্মস্থলের বাইরে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে সর্বোচ্চ দুই লাখ এবং শ্রমিকের সন্তানের উচ্চশিক্ষায় সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত শিক্ষা সহায়তা প্রদান করা হয়। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার  পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আগামী ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

এবিষয়ে কথা হয় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের কল্যাণে আমরা কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শ্রম মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে সকল কারখানাগুলোকে পরিদর্শনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। শ্রমিকদের স্বার্থে সরকারের নেওয়া নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের পদক্ষেপ কার্যকরী হলে শ্রমিকদের সুবিধা আরো বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবতা বলছে, শ্রম সেক্টরের এই নীরব বিপ্লব যা বাংলাদেশকে বিশ্বের রোলমডলে পরিণত করেছে। এমন অভিমত শ্রম বিশেষজ্ঞদের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads