• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৭ মার্চ ২০২২

যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ থেকে দুর্বারগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সত্তরের দশকে স্বাধীন এ দেশটিকে খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এক জনপদ হিসেবে চিনেছিল বিশ্ববাসী। কিন্তু মাত্র পঞ্চাশ বছরে সেই দেশের ভাবমূর্তি এখন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আর ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের লক্ষণীয় অগ্রগতি রয়েছে। তবে উন্নয়নের নতুন স্তরে যাওয়ার পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে।

কৃষিপ্রধান থেকে শিল্প ও সেবাপ্রধান অর্থনীতিতে রূপান্তর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধুনিকায়ন এনেছে। দেশ স্বাধীনের পর প্রথম অগ্রাধিকার ছিল কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার ছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। ১৯৭৫-৭৬ সালে বাংলাদেশ মাত্র ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এখন বছরে রপ্তানি হয় ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। তৈরি পোশাক খাত এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

আশির দশকে তৈরি পোশাক খাতে উদ্যোক্তা শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। বাণিজ্যিক কৃষি ও শিল্পের প্রসারের কারণে সেবা খাতের প্রসার ঘটে। নব্বইয়ের দশকে এসে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও টেলিকম খাতে নেওয়া নানা কর্মসূচি বাংলাদেশকে সামাজিক অগ্রগতিতে এগিয়ে নেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতিও আরেকটি প্রণিধানযোগ্য বিষয়। স্বাধীনতার পর ২০০৯ সাল পর্যন্ত চার দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। গত ১০ বছরে তা ২০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্য দেখিয়েছে। বাড়তি খরচ হলেও নিজেদের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ঢাকায় মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ চলছে। সম্প্রতি পায়রা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে, যা দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি অঞ্চলে উৎপাদনও শুরু হয়েছে।

স্বাধীনতার পর মাত্র পাঁচ দশকের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটেছে। এতে বেসরকারি খাত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮১ সালে জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। পুরো শিল্প খাতের অংশ জিডিপির প্রায় ৩৫ শতাংশ। এ সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন, এইচএসবিসির সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং-টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অধিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ তালিকায় বাংলাদেশের পরেই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার নাম এসেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে উন্নত দেশ নরওয়ের চেয়েও বাংলাদেশের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন-পেছনে তাকালে নিশ্চিত যে, গেল ৫০ বছরে আমরা অনেক এগিয়েছি। মাথাপিছু আয়, ব্যক্তির সক্ষমতা, রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, নগরায়ণ, প্রবাসী আয়, আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আয়, শিক্ষার প্রসার প্রায় সবকিছুরই বৃদ্ধি হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, চিকিৎসাব্যবস্থাও এগিয়েছে। বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতের প্রসার এবং একটি শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা সমাজও গড়ে উঠেছে। এ দেশে নারীর উঠে দাঁড়ানোর গল্প অপরাপর সমমানের দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। তারপরও আমরা বলতে পারছি না, আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ।

তার মতে, গত কয়েক দশকে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও অনেক ক্ষেত্রে সুশাসনকে পাশ কাটানো হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চায় বেশ ধস নেমেছে। দেশে ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ফলে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে মানুষের মধ্যে বৈষম্য। আর কোনো দেশে বৈষম্য বেড়ে গেলে কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচারও বেড়ে যায়। এসব কারণে উন্নয়নের নতুন স্তরে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার সুবিধা অনেক কমে যাবে। এ কারণে আগামী পাঁচ বছরের উত্তরণকালীন প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই উত্তরণে এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে উত্তরণের শক্তিশালী কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ এ অর্থনীতিবিদের।

তিনি আরো বলেন, স্থানীয় বাজার ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্নীতি কমানো, মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার প্রসারসহ অনেক বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়ার সুপারিশও উঠে আসছে বিভিন্ন আলোচনায়। বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে যেতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। তাদের জন্য ক্রমাগতভাবে কাজের ব্যবস্থা করা আগামী দিনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। তাই রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র সাবেক শিক্ষক অর্থনীতি বিশ্লেষক ডা. আর এম দেবনাথ বলেন, লড়াই সংগ্রাম করে স্বাধীনতা পাওয়া এ দেশটি শুরুতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে তকমা পায়। বিগত ৫০ বছরে ওষুধ, চামড়া, জাহাজ নির্মাণ, সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। তবে আমাদের রপ্তানিক্ষেত্রে বহুমুখীকরণ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। করোনাকালে অনেক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন।

তারপরও, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অগ্রগতিতে ইতিবাচক ইমেজ যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক ভাবমূর্তি এখনো দেখা যায়। তাই রাজনীতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে আরো এগোতে হবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশকে প্রথম থেকেই দেখানো হতো অত্যন্ত দরিদ্র একটা দেশ। দেশের লোক খাবার পাচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বন্যার ছবি। আশির দশকে নব্বই দশকের মধ্যেই আমরা আমাদের সামাজিক যে সমস্ত উন্নয়ন আছে সেই সূচকে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলাম। তখনো বাংলাদেশকে আগের মতোই ভাবমূর্তি ছিল। কিন্তু গত দশ-পনেরো বছরে যখন বাংলাদেশে ক্রমাগত জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে সেটা এখন সবার নজরে এসেছে। তাছাড়া পররাষ্ট্রনীতিতেও বাংলাদেশ বেশ বিচক্ষণতার সঙ্গেই গত কয়েকদশকে ভালো করছে। আমরা একসঙ্গে ভারত, চীন ওদিকে পাকিস্তান, জাপান এই যে নানার রকম চাপ এই সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এটা অনেকের নজরে এসেছে। তবে সুশাসন, রাজনীতি ও গণতন্ত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে বাংলদেশে। বাংলাদেশ বদলাতে সরকারের দায়িত্বশীলদের এদিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।  

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads