• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

আয়ের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৩ এপ্রিল ২০২২

পরপর দুই মাস সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে। ফলে দেশের গড় মজুরি যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে পণ্যের দাম। তাই আগের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছেন না দিনমজুর ও শ্রমিকরা। এতে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে তাদের।

সরকারি হিসাবে গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে, গত বছরের মার্চে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৬ টাকা ২২ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। আর যে দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের মার্চে তার মজুরির বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন, গত মার্চে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা।

এই হিসাব বলছে, দেশের দিনমজুর-শ্রমিকরা যে মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছেন না। বাড়তি মজুরি খেয়ে ফেলছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে। দুই বছরের মধ্যে তৃতীয়বার তৈরি হলো এ পরিস্থিতি। তাই বলা যায়, দেশে দিনমজুর-শ্রমিকের আয় কমেছে।

করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হয়েছে। ঈদ সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিপণিবিতানে কেনাকাটায় ভিড় দেখলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ায় মজুরিও বাড়ছে। কিন্তু সেই বাড়তি মজুরির টাকা খেয়ে ফেলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এখন মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে।

সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। অর্থনীতির সেই চিরায়ত প্রবণতায় উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মজুরিও বাড়ে। মজুরি বেশি বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতির আঁচ টের পান না তারা। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এখন বাংলাদেশে তাই হয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও তা-ই বলছে। অর্থাৎ এখন দেশের মানুষ যা উপার্জন করছেন বা যা মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে তাদের সংসার চলছে না। হয় ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে, না হয় অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কম কিনছেন বা কম খাচ্ছেন, সঞ্চয় করা বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো তো দূরে থাক।

করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের জুন মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯০। গত এক দশকের মধ্যে সেটিই ছিল ব্যতিক্রম ঘটনা। আবার সেই ব্যতিক্রম আবার ঘটেছে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে।

বিবিএস গত মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১৫। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি এই তথ্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, দেশের মানুষ কষ্টে আছেন। দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা। তবে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে বাজারের জিনিপত্রের দামের বাস্তব প্রতিফলন নেই। প্রকৃতপক্ষে এই হার অনেক বেশি।

সাধারণত মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হার বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য ১ শতাংশের মতো হয়। সরকারি হিসাবেই কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এখন তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে উঠেছে। যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু মজুরি সেই হারে বাড়ছে না। নভেম্বর, ডিসেম্বরে ও জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচক প্রায় সমান্তরালে চলেছে। ফেব্রুয়ারিতে এসে মজুরি বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায় মূল্যস্ফীতি।

গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক শূন্য ২। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। জানুয়ারিতে মজুরি হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

গত ২০২০-২১ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির (১২ মাসের গড় হিসাবে) হার ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ; মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন আছে। বিবিএসের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যের বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া যায় না। তারপরও বিবিএসের তথ্য মেনে নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দেশের মানুষ যা উপার্জন করছেন, তা দিয়ে তাদের সংসার চলছে না। মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়া সাধারণত অর্থনীতিতে দেখা যায় না। এখন সেটা হচ্ছে। এতেই প্রমাণ হয়, দেশের মানুষ কষ্টে আছেন। দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, ৫০ টাকার কমে কোনো চাল পাওয়া যায় না বাজারে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ সব জিনিসের দামই চড়া। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে। বেড়েছে মানুষের পরিবহন খরচ। রমজান সামনে রেখে আরেক দফা বেড়েছে পণ্যমূল্য। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। এর জেরে বেড়ে চলা খাদ্য সংকট বিশ্বকে একটি ‘মানবিক বিপর্যয়ে’র মুখে ফেলে দিয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস। ছোট-বড় সব দেশেই এখন মূল্যস্ফীতি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের কী হবে কে জানে।’

এ বিষয়ে অর্থনীতির আরেক গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গত মার্চ মাসে আমরা এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছি, বিবিএসের তথ্যের চেয়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। তারপরও বিবিএসের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের তথ্য নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও কিন্তু আমরা উদ্বেগজনক একটি তথ্য দেখতে পাচ্ছি। আর সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ আয় বাড়লেও মানুষের তা দিয়ে চলছে না। হয় ধার-দেনা করে চলছেন; না হয় কম খাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতি তা খেয়ে ফেলেছে।

সানেম মূল্যস্ফীতির এক বিকল্প হিসাব দিয়েছে। সংস্থাটি দাবি করেছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।

গত ৩ মার্চ ‘মূল্যস্ফীতি : সরকারি পরিসংখ্যান বনাম প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সানেম। এতে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে, তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে যদি সঠিক তথ্য তুলে আনা না হয়, তবে করোনার ক্ষতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না। নানা তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বিবিএস পুরনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই কষ্টে আছে। ভাত না খেয়ে অন্য কিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ।

বিবিএস প্রতি মাসে কৃষিশ্রমিক, পরিবহনকর্মী, বিড়িশ্রমিক, জেলে, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিকসহ ৪৪ ধরনের পেশাজীবীর মজুরির তথ্য সংগ্রহ করে মজুরির হার সংক্রান্ত সূচক তৈরি করে। এসব পেশাজীবীর মজুরি খুব কম এবং দক্ষতাও কম। শুধু দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান বা নগদ টাকার পরিবর্তে অন্য সহায়তা পান, তার ভিত্তিতে কোন মাসে মজুরি হার কত বাড়ল, তা প্রকাশ করে বিবিএস।

পরিসংখ্যান ব্যুরো যে ৪৪ ধরনের পেশাজীবীর মজুরির তথ্য নেয়, তার মধ্যে ২২টি শিল্প খাতের এবং ১১টি করে কৃষি ও সেবা খাতের পেশা। বেতনভোগী কিংবা উচ্চ আয়ের পেশাজীবীদের বিবিএসের মজুরি সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশই হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। মোট শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই এ খাতে নিয়োজিত। আর ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।

অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। শিল্প খাতের ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ, সেবা খাতের ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত।

বিবিএস বলছে, মার্চ মাসে কৃষি খাতে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতে বেড়েছে যথাক্রমে ৬ দশমিক শূন্য সাত এবং ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।

অন্যদিকে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। খাদ্য বহির্ভূত ৬ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। এই মাসে গ্রামে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ; আর শহর এলাকায় ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

এ ক্ষেত্রেও বিবিএসের পরিসংখ্যানে বিস্ময়কর তথ্য বেরিয়ে এসেছে, শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads