• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
পি কে হালদারকে দেশে ফেরানোর ধোয়াশা কাটেনি

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

পি কে হালদারকে দেশে ফেরানোর ধোয়াশা কাটেনি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৭ মে ২০২২

কোন প্রক্রিয়ায় ভারতে গ্রেপ্তারকৃত পি কে হালদারকে দেশে ফেরত আনা হবে সেই বিষয়টি এখনো স্পষ্ট হয়নি। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবেও পি কে হালদারের গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানানো হয়নি বাংলাদেশকে। তবে দুদকসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরত আনার বিষয়ে চেষ্টা চলছে বলে জানা যায়। ভারত-বাংলাদেশ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ীও পি কে হালদারদের বাংলাদেশে ফেরানো যাবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। পি কে হালদারকে দেশে ফেরত আনতে দুদকের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের সাহায্য চাওয়া হয়েছে।

এদিকে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা চেয়ে রুলের শুনানির জন্য আজ মঙ্গলবার দিন ঠিক ধার্য করেছে আদালত। আর পিকে হালদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েক কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভারতে গ্রেপ্তাকৃত পি কে হালদার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে দেশে ফেরত আসতে চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভারতের গণমাধ্যমকে।

তবে পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আইন আইনের পথে চলবে। আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিই না। জানা যায়, ভারতের আইন অনুযায়ী এ দেশের পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড জাল করে বেআইনিভাবে এ দেশে থাকার জন্য যদি আলাদা মামলা হয়, সেই বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে, শাস্তির মেয়াদ শেষ করে প্রশান্ত কুমার হালদারদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে এক বছর সময় লাগতে পারে।

এখন নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার বন্দি পি কে হালদার চক্রের প্রত্যর্পণ বিষয়ে ভারত সরকারকে অনুরোধ করলে বন্দিকে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়ে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। তারপরই প্রশান্ত কুমার হালদারদের বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। আবার ২০১৩ সালের ভারত-বাংলাদেশ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী পি কে হালদারদের বাংলাদেশে ফেরানো যাবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে।

তবে তিনি ভারতে এসে জালিয়াতচক্র, অবৈধ ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এমনকি পাসপোর্ট তৈরির মতো অপরাধ করে নাগরিক হিসেবে থাকছিলেন। ভারতীয় আইনে এসবই গুরুতর অপরাধ। এসব বিষয়ে ইডি যদি তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তার বিচারপ্রক্রিয়া ভারতের মাটিতে শুরু হয় তবে সে ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ শেষ করে পি কে হালদারদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ হবে।

প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে ভারত থেকে দেশে ফেরত আনতে ইন্টারপোল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে তাকে কবে নাগাদ ফেরত পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেনি বলে দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব ও মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান জানিয়েছেন।

গতকাল সোমবার রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয় প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে সাঈদ মাহবুব খান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ইন্টারপোল অথরিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমাদের জন্য খুব ভালো খবর হচ্ছে, ইন্টারপোল অথরিটি খুব দ্রুত রি-অ্যাক্ট করেছে। তারা দ্রুতই আমাদের আসামি ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে।’

কত দিনের মধ্যে তাকে আনা যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত) বলেন, এটা আসলে সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। কী পরিমাণ মামলা সেখানে (ভারতে) হয়েছে, সে মামলাগুলোর বিচারে কত দিন লাগবে বা বিচারের আগে ফেরত আনা যাবে কি যাবে না, সুনির্দিষ্ট করে বলাটা আসলে সঠিক হবে না।

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, পি কে হালদার ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। তবে জানামাত্র তাকে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত শনিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা নিয়ে দুদক কাজ করছে। অনেকে নামে-বেনামে দেশ থেকে টাকা পাচার করছে। তারা দেশের শত্রু। তাদের ধরে নিয়ে আসা ভালো। পি কে হালদারের মতো ধরে নিয়ে আসার দু-একটি দৃষ্টান্ত হলে তা আরো ভালো হবে।

ইডির হেফাজতে থাকা পি কে হালদারসহ এক নারী ও পাঁচ পুরুষকে গতকাল সোমবার সকালে রুটিন চেকআপের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘণ্টাখানেক রাখার পর ইডির সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সের অফিসে তাদের ফিরিয়ে আনেন তদন্তকারীরা। ওই সময় লিফটের বাইরে থাকা সাংবাদিকরা তার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান। জবাবে পি কে হালদার বলেন, আমি দেশে ফিরতে চাই। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।

এদিকে ভারতে গ্রেপ্তার পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর জারি করা রুলের ওপর আজ মঙ্গলবার শুনানির দিন নির্ধারণ করেছেন হাইকোর্ট। তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি নজরে আনার পর গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

এর আগে ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের দেশে ফেরত আসতে কোনোরকম গ্রেপ্তার না করার নির্দেশনা চেয়ে একটি আবেদন করে তার প্রতিষ্ঠান আইএলএফএসএল। সে আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত জানিয়েছিলেন, পি কে হালদার কবে, কখন, কীভাবে দেশে ফিরতে চান তা আইএলএফএসএল লিখিতভাবে জানালে সে বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দেওয়া হবে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পরে একই বছরের ১৯ নভেম্বর এ বিষয়ে রুল জারি করেছিলেন আদালত।

পরে পি কে হালদারের দেশে ফেরার বিষয়টি হাইকোর্টকে জানানো হয়। সার্বিক দিক বিবেচনার পর পিকে হালদারকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে পি কে হালদার দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের আইজি এবং ইমিগ্রেশন পুলিশকে নির্দেশ দেন আদালত। পাশাপাশি কারাগারে থাকাবস্থায় পি কে হালদার যেন অর্থ পরিশোধের সুযোগ পান সে বিষয়ে সুযোগ দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তবে পরে আর তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে দেশে ফেরেননি।

তবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে গা ঢাকা দিয়েছিলেন বাংলাদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার । তিনি শিবশংকর হালদার নামে নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। বানিয়ে ফেলেছিলেন ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ডসহ বিভিন্ন ভারতীয় নথি। নিয়মিত ভোট দিতেন, নিযুক্ত ছিলেন সরকারি চাকরিতেও। কিন্তু গত ১৪ মে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে ধরা পড়েন তিনি। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন আরো পাঁচজন।

এদিকে অর্থ আত্মসাতের মামলায় পিকে হালদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েক কর্মকর্তার নাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে। টানা পাঁচ বছর ধরে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ বাংকের অডিট শাখার এসব কর্মকর্তা চুপ ছিলেন। পিকে হালদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর এসব কর্মকর্তা যেন পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য তাদের কঠোর নজরদারিতে রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নজরদারিতে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরী ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। এর আগে গত বছর এই দুজনসহ তাদের স্ত্রীদের ব্যাংক হিসাব তলব করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি তাদের সব ধরনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল এনবিআর।

জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে পি কে হালদারচক্রের বহু সম্পত্তি চিহ্নিত করে, তার কাগজ ও প্রয়োজনীয় নথি বাজেয়াপ্ত করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। ১১টি বাড়ি, জমির খোঁজ পেয়েছে ইডির তদন্তকারীরা। পি কে হালদারকে সঙ্গে নিয়ে গত সোমবার বাকি সম্পত্তির খোঁজে তল্লাশি চালানো হয় বলে ইডি সূত্রে জানা গেছে। সুকুমার মৃধা, প্রণব হালদারের মতো সহযোগীরা প্রশান্ত হালদারের বেআইনি কাজের অংশ ছিলেন। অশোক নগরে তাদের বিলাসবহুল বাড়ি, জমি সম্পত্তি ও গাড়ির বহর দেখে স্থানীয় মানুষ সন্দিহান ছিলেন। আর উত্তর ২৪ পরগনায় আত্মগোপন করে থাকা পি কে হালদারচক্র মাছের ভেড়ির ব্যবসা খুলে বসেছিলেন। এরই আড়ালে চলত বেআইনি কাজ কারবার।

সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা ঘুরে পি কে হালদার ভারতে গা ঢাকা দিয়েছেন- এমন খবর প্রথম ইডিকে জানান বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে গ্রেপ্তার করতে ইডিকে অনুরোধ জানায়।

অন্যদিকে পি কে হালদারের অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ও ঘনিষ্ঠ হিসেবে অন্তত ৭০ জনের একটি তালিকা করেছিল বিএফআইইউ ও দুদক। তাদের অনেকেই ভারতে গিয়ে নামের আংশিক পরিবর্তন করে জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের পর কানাডায় পালিয়ে যান প্রশান্ত কুমার হালদার। দুদক পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা করেছে।

২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটানো হয়। তাকে সহযোগিতা করতেন প্রণব কুমার হালদার ও ছোট ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads