• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ডলারের দামে হেরফেরে ব্যাংকগুলোতে

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ডলারের দামে হেরফেরে ব্যাংকগুলোতে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৭ মে ২০২২

ডলারে দাম পার্থক্য হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংকে। রাজধানীতেই এমন অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর বেঁধে দিয়েছে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা মানছে না বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ব্যাংকে এলসি করতে গেলে ডলারের বিপরীতে নেওয়া হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৬ টাকা।

এমনই এক ভোক্তা খাদ্যপণ্য আমদানিকারক মাওলা ট্রেডার্সের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। ডলার নিয়ে তার সামপ্রতিক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি।

আনোয়ার হোসেন বলেন, গত সপ্তাহে দুটি ব্যাংকে গেলাম। একটি ব্যাংক সরাসরি বলে দিল ডলারের সংকট চলছে, এখন এলসি করা যাবে না। পরে আরেকটি ব্যাংকে গেলাম, ডলারের দর চাইল ৯৫ টাকা। এরপর আরো তিন-চারটি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে এলসি করলাম ৯২ টাকা দরে।

ব্যাংকগুলো সুযোগ পেলেই বেশি দাম আদায় করছে জানিয়ে মাওলা ট্রেডার্সের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ঈদের আগে একটি এলসি খুলেছিলাম। ব্যাংক বলল, ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ৬০০ টাকা জমা দিতে। ঈদের আগের কর্মদিবসে এ টাকা চেয়েছে, কিন্তু ওইদিন টাকা জমা দিতে পারিনি। ঈদের পর প্রথম কর্মদিবসে পরিশোধ করতে গেলাম, আমার কাছ থেকে নিল ১৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এক সপ্তাহে ৭৪ হাজার ৪০০ টাকা বেশি নিল। এই হিসাব কে করবে?

তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার যমুনা ব্যাংকে এলসি করতে গেলে ডলারের দর চেয়েছে ৯২ টাকা। এর কমে এলসি খুলতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় মূলধনীয় যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্য আমদানি ব্যাপকহারে বেড়েছে। এই আমদানি দায় এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে ডলারের চাহিদা বেড়েছে, এর ফলে দামও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের বিশ্লেষণ করে ডলারের দাম ঠিক করে দিচ্ছে। এক সময় বাজার ঠিক রাখতে ডলার কিনেছে, এখন বিক্রি করছে। ডলার স্থিতিশীল রাখতে বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় যা করা দরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা করবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন ডলারের দর ঊর্ধ্বমুখী। তারপরও আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়মেই এলসি খুলছি। আমদানিকারকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশি দাম নিচ্ছি এটা ঠিক নয়। তবে যারা ডলার ফরোয়ার্ড বুকিং অর্থাৎ আগাম ডলার কিনে এলসি খুলছে, সোয়াপ ট্রানজেকশন করছে, তাদের দর বেশি পড়ছে। কারণ কেউ যদি অগ্রিম ডলার কিনে এলসি করতে চায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের দর বেশি পড়বে এটাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, আমাদের আমদানি বেশি হওয়ায় ডলারের চাপ বেড়েছে। এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।

ডলারের ঊর্ধ্বগতিতে এলসি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আরেক আমদানিকারক এলিওন ট্রেডার্সের মালিক পারভেজ আহমেদ। তিনি জানান, আমরা খাদ্যপণ্য আমদানি করি। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি, অন্যদিকে ডলারের সংকট। আজ এক দর দেখে পণ্য অর্ডার দিই, কাল দেখি আরেক দর। ব্যাংকগুলো এখন প্রতি মুহূর্তেই ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। সবশেষ গত রোববার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে একটি এলসি পরিশোধ করেছি, তারা নিল ৯৪ টাকা ৫০ পয়সা। যদি প্রতি ডলারে ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি লাগে তাহলে পণ্য এনে ব্যবসা করব কীভাবে?

ডলারের দাম নিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এখন অনেক বিদেশি ব্যাংক ডলার ৯৪/৯৫ টাকায় কিনছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে বাজারের কী অবস্থা। আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ডলার কিনেই এলসি খোলে। এখন ব্যাংক বেশি দামে কিনে তো কম দামে বিক্রি করবে না।

এখন কী করা উচিত চানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান বলেন, চাহিদা বাড়ায় ডলারের দাম বেড়েছে। এখন দর ঠিক রাখতে হলে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ভালো। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এক দাম বেঁধে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো আরেক দামে কেনাবেচা করছে। লাভ কী তাহলে? এতে যেকোনো সময় বাজার অস্থির হয়ে যেতে পারে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই ডলারের দাম বাজারের ওপর নির্ভয় করে। আমাদেরও ছেড়ে দেওয়া উচিত।    

হু হু করে বাড়ছে ডলারের দাম। বিক্রি করেও ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত এক মাসের ব্যবধানে কাগজে-কলমে ডলারের দাম বেড়েছে ৫০ পয়সা। কিন্তু বাস্তবে বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। এখন ব্যাংকগুলো ৯৩ থেকে ৯৪ টাকায় ডলার বিক্রি করছে। তবে খোলাবাজার ও নগদ মূল্যে ডলার আরো বেশি দামে ৯৫ থেকে ৯৬ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। যদিও আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের দর বেঁধে দেওয়া আছে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো এলসি খোলার ক্ষেত্রে ডলারপ্রতি কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টাকা বেশি নিচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক এর চেয়েও বেশি আদায় করছে।

ডলারের দাম ২০-৫০ পয়সা বাড়লেই বাজারে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়। সেখানে ৭ টাকা বাড়তি নেওয়া রীতিমত ভয়ংকর পরিস্থিতি বলে মনে করছেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী। তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ক্ষোভ প্রকাশ করে এক আমদানিকারক বলেন, সবাই শুধু বলে আমরা নাকি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিই। বেশি দামে পণ্য বিক্রি করি। ভোক্তা অধিদপ্তর এসে জরিমানাও করে। এখন ব্যাংকগুলো যে আমাদের কাছে ডলারের দাম নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি নিচ্ছে এটা কে দেখবে? তাদের তো কেউ জরিমানাও করে না।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাপক হারে আমদানি বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়েনি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে তেল, ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের দাম। ফলে আমদানির খরচ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বর্হিবিশ্বের যোগযোগ পুরোদমে চালু হয়েছে। মানুষ পেশাগত কাজ, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কেনাকাটার জন্য বিভিন্ন দেশে যাতায়াত শুরু করেছেন। এখানেও বাড়তি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। এসব কারণে ডলারের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেও ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।

২০২১ সালের আগস্টের শুরুতেও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য একই ছিল। ৩ আগস্ট থেকে দুই-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ৮৫ টাকা ছাড়ায়। এ বছরের ৯ জানুয়ারিতে এটি বেড়ে ৮৬ টাকায় পৌঁছে। এরপর ২২ মার্চ পর্যন্ত এ দরেই স্থির ছিল। পরে গত ২৩ মার্চ আন্তঃব্যাংকে আরো ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২৭ এ‌প্রিল আরো ২৫ পয়সা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। ১০ মে বাড়ে আরও ২৫ পয়সা। ফলে এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম গিয়ে ঠেকেছে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সায়। যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ মূল্য। অর্থাৎ গত ৯ মাসের ব্যবধানে প্রতি ডলারে দর বেড়েছে এক টাকা ৯০ পয়সা।

কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংকের ডলার কেনাবেচার দর ৯০ টাকার উপরে। কোনো কোনো ব্যাংক প্রতি ডলারের মূল্য ৯৫-৯৬ টাকাও নিচ্ছে।

রেকর্ড ডলার বিক্রি : চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১২ মে পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৫০২ কোটি (৫.০২ বিলিয়ন) ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এর আগে বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত অর্থবছরে ডলার কেনায় রেকর্ড গড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সবমিলিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রিজার্ভের ওপর পড়ছে চাপ : এদিকে আমদানির চাপে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের (রিজার্ভ) ওপর চাপ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ আগের সব রেকর্ড ভেঙে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। দেশের ওই রিজার্ভ গত ১১ মে (বুধবার) ৪১.৯৩ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ১৯৩ কোটিতে নেমে এসেছে।

রপ্তা‌নির চেয়ে আমদানি বেড়েছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আলোচিত ৯ মাসে রপ্তানি থেকে দেশ আয় করেছে তিন হাজার ৬৬২ কোটি ডলার। পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় থেকে রপ্তানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৯০ কোটি ডলার।

রেমিট্যান্স : জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। যা ছিল আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads