• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
বন্ধ হয়নি বিষাক্ত বর্জ্যের উৎসমুখ

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

বুড়িগঙ্গার অক্সিজেনের পরিমাণ ০.২৪ মিলিগ্রাম

বন্ধ হয়নি বিষাক্ত বর্জ্যের উৎসমুখ

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ১২ জুন ২০২২

বিষাক্ত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি। কমে গেছে অক্সিজেনের পরিমাণ। যেখানে গড়ে ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার কথা, সেখানে নেমেছে শূন্য দশমিক ২৪ মিলিগ্রামে নদী দূষণের উৎসমুখগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ ও নদীর নাব্যতা রক্ষায় সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে ২০০৯ সালে গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। এই কমিটি গত ১৩ বছরে প্রায় অর্ধশত বৈঠক করেছে। অভিযোগ উঠেছে, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও অবহেলার কারণে ঢাকার চারদিকে বিভিন্ন নদীতে পড়া বর্জ্যের উৎসমুখ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নদী দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৮৩ কোটি ডলার। এ পরিস্থিতি নিরসনে কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হলে, নদী দূষণের কারণে মোট আর্থিক ক্ষতির অঙ্ক আগামী ২০ বছরে ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে।

জানা গেছে, ঢাকার চারপাশে নদীগুলোর ৬০ শতাংশ দূষণই হয় শিল্প বর্জ্যের কারণে। দুই সিটি করপোরেশন নিষ্কাশন নালার মাধ্যমেই ১৫ শতাংশ দূষণ হয়। ১০ শতাংশ ঘটছে জাহাজ, লঞ্চ ও অন্য নৌযানের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি এবং মলমূত্র নদীর পানিতে মেশার ফলে। প্রকৃতপক্ষে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী এবং টঙ্গী খালে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য প্রধানত ৯টি শিল্পঘন এলাকা— টঙ্গি, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে আসে। তাই আগামী ২০২৩ সালের ১৭ মার্চের মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানির মান ঠিক করতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীতে ৬৩১ পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য সরাসরি পড়ছে। এছাড়া চারটি নদীর দূষণের জন্য ঢাকা ওয়াসাকেও দায়ী করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এসব নদীর বিষাক্ততার কারণে নদীর মাছ ও পোকামাকড়সহ কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারছে না।
৬৩১ পয়েন্টের মধ্যে ২৫৮টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালি, শিল্পবর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এছাড়া তুরাগ নদীতে ২৬৯টি ও বালু নদীতে ১০৪ পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য পড়ছে। কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গার সদরঘাট এলাকায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ২৪ মিলিগ্রাম এসে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গা একটি। এই নদীর পানিতে ক্ষতিকর পদার্থ ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু রয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)-এর বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণরোধে ২০১৯ সালে এক কর্ম পরিকল্পনার প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়।

বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদী প্রতিদিন মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। এই দূষণের ফলে নদীর পানি তার স্বাভাবিক রঙ হারিয়ে ফেলেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০০৭ অনুযায়ী মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন ৫ মিলিগ্রাম।

বর্ধমানে ধোলাইখালের ফরিদাবাদ এলাকায় আছে শূন্য দশমিক ৭৯ মিলিগ্রাম, শ্যামপুর খালের মুখে আছে শূন্য দশমিক ৯৮ মিলিগ্রাম, পাগলা ওয়াসা ট্রিটমেন্ট প্রয়েন্টে নির্গত ড্রেনের ভাটিকে অক্সিজেন আছে শূন্য দশমিক ৫৬ মিলিগ্রাম, পাগলায় এলাকায় আছে শূন্য দশমিক ৬৩ মিলিগ্রাম, মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে অক্সিজেন আছে শূন্য দশমিক ২৯ মিলিগ্রাম এভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণের অক্সিজেন আছে গাবতলী ব্রিজের নিচে ২ দশমিক ২ মিলিগ্রাম।

এর মধ্যে টঙ্গীর কামাড়পাড়ার প্রত্যাশা ব্রিজ থেকে পাগাড় পর্যন্ত প্রায় ২২টি ডাইং ও ওয়াশিং কোম্পানির কারখানা থেকে দূষিত রঙিন পানি সরাসরি পড়ছে তুরাগ নদে। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পয়েন্টগুলো সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার তৈরি। নদী তীরে গড়ে ওঠা অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্যে দূষিত ঢাকার নদীগুলো।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী জানান, ২০২৩ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর আগেই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দূষণমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উদযাপনের আগেই আমরা নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করব। এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।’ অনেকে এটাকে অসম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আমি বলব ৯ মাসে যদি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা যায়, তাহলে এ ৯ মাসে আমরা কেন নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে পারব না বলে তিনি জানান।

এদিকে গত ৭ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় রাজধানী ঢাকার আশপাশের চারটি নদীর দূষণের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি আলোচনা সভায় বলেছেন, ঢাকার আশপাশের চারটি নদীর দূষণে যদি কোনো একক প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়, তাহলে সেটি হবে ঢাকা ওয়াসা। ঢাকার যত মলমূত্র আছে, তার ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশই এ চার নদীতে যায়। এটা কীভাবে যায়। ওয়াসার দায়িত্ব ছিল এসবের সমাধান করা।

পানির অপর নাম জীবন উল্লেখ করে তিনি আরো জানান, অথচ এখন এ পানিই আমাদের জন্য মরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মার্চ মাসে আমি ঢাকার উত্তরে নদী সফর করেছি, আমি খুঁজেছি কোথায় গেলে আমি এমন একটা নদী পাব যেখানে মানুষ গোসল করছে। রাজধানী থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ‘সুতিয়া’ নামে গোসল করার মতো একটা নদী পাওয়া গেল। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম, কিছু মানুষ তাতে গোসল করছে, কেউ কেউ মাছ ধরছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, পরিবেশ দূষণের কারণেই এখন ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এসব পানি এখন কলেরার উৎস। ঢাকাসহ চারপাশে প্রায় চার কোটি মানুষের বসবাস। তাদের জন্য কোনো একটা নদী বা জলাশয় নেই যেখানে কেউ গোসল করতে পারে। এটাও এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। ঢাকার চারপাশে এসব নদীতে কোনো ঝিনুক নেই, মাছ নেই, নেই কোনো মাছরাঙা পাখি বা চিল।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads