পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে নতুনরূপে সাজছে দক্ষিণের সাগরকন্যা কুয়াকাটা। এই সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা। ফলে বিপুল পর্যটক সমাগমের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের আপ্যায়নের বিষয়টি মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক মানের খাবার ব্যবস্থাসহ নতুনরূপে সাজানো হচ্ছে এখানকার হোটেল-মোটেল।
পর্যটন ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে ভোরে যাত্রা করে দুপুরের আগেই কুয়াকাটা পৌঁছানো যাবে। এরপর দিনভর আনন্দ উল্লাস করে শেষ বিকেলে সূর্যাস্ত দেখে রাতে আবার ঢাকায় ফিরতে পারবেন পর্যটকরা। স্বল্পকালীন থাকার ব্যবস্থা রেখে অধিকাংশ হোটেল বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি আবাসিক হোটেলে ৫০ এবং খাবার হোটেলে ৩০ ভাগ ভাড়া ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
একসময়ে ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় সড়ক পথে যেতে একাধিক ফেরি পার হতে হতো। সেসব নদীতে সেতু হয়ে গেছে। এবার পদ্মায় সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়কে আর কোনো ফেরি থাকবে না। এতে কোনো দুর্ভোগ ছাড়াই স্বল্প সময়ে কুয়াকাটা পৌঁছতে পারবেন পর্যটকরা।
স্ত্রীসহ কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা গাজীপুরের চাকরিজীবী আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার শেষবারের মতো ফেরি পার হয়ে কুয়াকাটায় এলাম। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই পথে আর কোনো ফেরি থাকবে না কয়েক বছর আগে একবার এসেছিলাম। সে যে কী ভোগান্তি, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দিনের প্রায় অর্ধেকটা সময় কয়েকটি ফেরিঘাটে আটকে ছিলাম। কুয়াকাটায় আসার আনন্দ ধুলোয় মিশে গিয়েছিল। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত কোনোটাই দেখতে পারিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার জুই বলেন,পদ্মা সেতু হলে কুয়াকাটায় আসা অনেক সহজ হবে। আগে সময় পেলেই গাড়িতে কক্সবাজার যেতাম। ফেরির কারণে এখানে আসতে চাইতাম না। তবে ২৫ জুনের পর ইচ্ছা করলেই খুব ভোরে ঢাকা থেকে কুয়াকাটার উদ্দেশে রওনা হতে পারব। দিনভর থেকে সন্ধ্যায় আবার রওনা করলে রাতেই হলে গিয়ে পৌঁছাতে পারব। সুমাইয়ার ধারণা, পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ স্বল্পসময়ে স্বল্পব্যয়ে কুয়াকাটা ভ্রমণ করতে পারবে।
পদ্মা সেতুর কারণে পরিবহন শ্রমিকরাও খুশি। আগে দিনে একবার ট্রিপ দিলেও এখন একাধিক ট্রিপের সুযোগ মিলবে বলে ধারণা তাদের। পদ্মা সেতু উদ্বোধন সামনে রেখে ইতোমধ্যে প্রচেষ্টা, গ্রিনলাইনসহ একাধিক নতুন কোম্পানির বাস চালু হয়েছে কুয়াকাটা লাইনে। আরো বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাস চালুর কথা রয়েছে।
পটুয়াখালী জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন মৃধা বলেন, উন্নতমানের বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এই রুটে তারা গাড়ি চালাতে চায়। আমরা তাদের স্বাগত জানিয়েছি। এখনই কুয়াকাটায় বাংলাদেশের অধিকাংশ কোম্পানির বাস চলাচল করছে। তবে ২৫ তারিখের পর ঢাকা, চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি উন্নতমানের বিলাসবহুল বাস এই রুটে প্রবেশ করবে।
কুয়াকাটার হোটেল ব্যবসায়ীদেরও এখন ব্যস্ত সময়। পর্যটক আকৃষ্ট করতে তৈরি করা হচ্ছে নতুন অবকাঠামো। এখানকার সবচেয়ে বড় সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলাসের মহাব্যবস্থাপক আল আমিন বলেন, আমরা দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করেছি। হোটেলে আবাসন সিটের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকদের জন্য আমরা নতুন নতুন ভিউ তৈরি করেছি।
ইতোমধ্যে ২৫ তারিখের পরের কয়েক দিনের জন্য অগ্রিম বুকিংয়ের ব্যাপারে অনেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে প্রতিদিনই পর্যটকরা জানতে চাইছেন।
সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম মেরণ বলেন, ২৫ তারিখের পর পর্যটকের বাড়তি চাপের বিষয়টা মাথায় রেখে আমাদের হোটেলকে নতুনরূপে সাজিয়েছি। তা ছাড়া যেসব পর্যটক সকালে এসে আবার সন্ধ্যায় ঢাকায় ব্যাক করবে তাদের জন্যও আমরা নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করে প্রস্তুত রেখেছি।
ইলিশপার্কের স্বত্বাধিকারী ইমতিয়াজ তুষার বলেন, কুয়াকাটায় পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ ইলিশপার্ক। আমরা কক্সবাজারের চেয়েও অনেক ভালোমানের খাবার বিশেষ করে স্বল্পমূল্যে বেশ কয়েক ধরনের ভর্তার ব্যবস্থা চালু করেছি। মূলত আমরা চাই, একাধিকবার কক্সবাজারে যাওয়া কোনো পর্যটক এখানে এসে যেন কিছু না কিছু নতুনত্ব পান। তা ছাড়া এখানকার সৌন্দর্য তো আছেই। বিভিন্ন হোটেলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্নতমানের খাবার পরিবেশনসহ বিভিন্ন সেবা দিতে দক্ষ জনবলও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
কুয়াকাটা সিকদার রিসোর্টে বিদেশি পর্যটকদের খাবার পরিবেশনের জন্য বিশিষ্ট শেফ জুলফিকার মো. জাহিদি ওরফে শেফ জাহিদিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আশাকরি, পর্যটকরা আমাদের খাবার পরিবেশনে খুশি হবেন।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জানান, গোটা পৌর এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নসহ পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ভ্রমণপিপাসুদের জন্য কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থানগুলোকেও নতুনরূপে সাজানো হয়েছে আশা করছি, এখানে এসে কোনো পর্যটক হয়রানির শিকার হবেন না। এ জন্য সৈকতে ফটোগ্রাফারসহ ভ্রাম্যমাণ খুদে ব্যবসায়ীদের কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশের কর্মকর্তা হাসনাইন পারভেজ বলেন, পর্যটকদের বাড়তি নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ টিমসহ একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। গোটা সৈকতের নিরাপত্তার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।
পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটার সমৃদ্ধির পাশাপাশি গোটা অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে বলে মনে করছেন পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজর রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে। তাই এ এলাকায় তিনি বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। পদ্মা সেতুর সুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করবে কুয়াকাটাবাসী। এই সেতু পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক কুয়াকাটায় অনায়াসে আসতে পারবে। বদলে যাবে এ এলাকার দৃশ্যপট।