• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ভেঙে গেছে জঙ্গি নেটওয়ার্ক

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ভেঙে গেছে জঙ্গি নেটওয়ার্ক

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০১ জুলাই ২০২২

রাজধানীর অভিজাত হোটেল হলি আর্টিজানে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল জঙ্গি ভয়াবহ হামলা চালিয়ে হতবাক করে দেয় সারা দেশকে। ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিদের এই ভয়াবহ হামলায় স্তম্ভিত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। সে রাতে ৬ নব্য জেএমবির জঙ্গি ওই হোটেলে ঢুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দেশি-বিদেশি অতিথিদের। হত্যা করে ১৭ জন বিদেশিকে। এটি দেশের ইতিহাসের অন্যতম এক জঘন্য অধ্যায়। রুদ্ধশ্বাস ১৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পর সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল অভিযান চালালে নিহত হয় ওই ৬ জঙ্গি। ওই ঘটনায় নিহত হয় মোট ২৫ জন। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান। আবিষ্কৃত হতে থাকে একের পর এক জঙ্গি আস্তানা। একের পর এক অভিযানে তছনছ হয় জঙ্গি আস্তানা ও নেটওয়ার্ক।

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর ঢাকার কল্যাণপুর, রূপনগর, আজিমপুর, আশকোনা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, সিলেট এবং রাজশাহীতে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ও এলিট ফোর্স র্যাব। এসব অভিযানে ‘নব্য জেএমবির’ শীর্ষনেতা তামিম চৌধুরীসহ নিহত হয় অন্তত অর্ধশতাধিক জঙ্গি সদস্য। ভয়াবহ গুলশানে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনার ৬ বছর আজ।

অপারেশন থান্ডার বোল্ট : গুলশানে জঙ্গি দমনে ও জিম্মি ঘটনা অবসানের জন্য পরিচালনা করা হয় থান্ডার বোল্ট অপারেশন। অভিযানে অংশ নেয় সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চার সহস্রাধিক সদস্য। সে বছর ২ জুলাই সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অভিযান শুরু হয়। মাত্র ১২-১৩ মিনিটে শেষ হয় অভিযান। থান্ডার বোল্ট অভিযানের তত্ত্বাবধান করেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ সফিউল হক। আরো ছিলেন নৌবাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‍্যাবের মহাপরিচালক ও অন্যান্য সংস্থার প্রধানরা। কমান্ডো অভিযানে ৬ জঙ্গি নিহত হয়।
এ হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই সে বছর ঈদুল ফিতরের দিন সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর বোমা হামলা এবং গোলাগুলিতে দুই কনস্টেবলসহ চারজন নিহত হন। হামলার দিনই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় আবীর রহমান নামে নব্য জেএমবির এক সদস্য। আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হয় শফিউল নামে আরেক জঙ্গি।

এরপর শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান। জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড, অস্ত্রদাতা, অর্থদাতা, প্রশিক্ষণ-প্রশিক্ষক ও জঙ্গিদের আশ্রয়দাতাদের শনাক্ত করা হয়। তদন্তে উঠে আসে নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়ানো উগ্রপন্থি সংগঠন নব্য জেএমবি। পরে ওই বছরের ৫ আগস্ট র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শফিউল ও তার সহযোগী আবু মোকাতিল নামে দুই সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়।

কল্যাণপুরে অপারেশন স্টোর্ম-২৬ : ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের একটি জঙ্গি আস্তানার সংবাদ পায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখানে চলে ‘অপারেশন স্টোর্ম’। এতে নিহত হয় ৯ জঙ্গি। নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় জানা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জে অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ : একই বছরের ২৭ আগস্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। ওই অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবি নেতা ও গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরী। এ সময় তামিমের সঙ্গে মারা যায় তার আরো দুই সহযোগী।

রূপনগরের আস্তানায় হামলা : ২ সেপ্টেম্বর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট অভিযান চালায় মিরপুরের রূপনগরে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয় জাহিদুল ইসলাম নামে অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণকারীদের তিনি গাইবান্ধার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেন। নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবিতে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল মুরাদ ওরফে মেজর মুরাদ ওরফে জাহিদুলের।

আজিমপুরে আস্তানায় হামলা : ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখানে নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আশ্রয়দাতা তানভীর কাদেরী নিহত হয়। সেখান থেকে আটক করা হয় তিন নারী জঙ্গি ও তানভীরের ১৪ বছর বয়সী ছেলেকে।

গাজীপুরে অপারেশন ‘স্পেইট-এইট’ : গত ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর জঙ্গি দমনের ছিল একটি সফল দিন। পুলিশ ও র্যাব গাজীপুর, আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলের চার আস্তানায় অভিযান চালায়। গাজীপুরে পৃথক দুই অভিযানে ৯ জঙ্গি, টাঙ্গাইলে দুই জঙ্গি এবং আশুলিয়ায় নিহত হয় জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা।

আশকোনা অপারেশন ‘রিপল ২৪’ : বছরের শেষ দিকে ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় প্রায় ১২ ঘণ্টার পুলিশি অভিযানে জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দুজন নিহত হয়েছেন। আহত অবস্থায় এক শিশুকে উদ্ধারের পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করে নিহত আরেক জঙ্গিনেতা জাহিদুল ইসলামের স্ত্রীসহ চারজন। সমাপ্তি শেষে অভিযানটির নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন রিপল-২৪’। ওই বাড়িতে ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণে’ নিহত দুজনের একজন হলেন জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ছেলে আফিফ কাদেরী আদর (১৪)। নিহত অন্যজন জঙ্গিনেতা সুমনের স্ত্রী শাকিরা।

অপারেশন ‘অ্যাসল্ট ১৬’ : ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ প্রথম জঙ্গি আস্তানায় এ ধরনের প্রথম অভিযান পরিচালনা করল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৫ মার্চ সন্ধান পাওয়া এ আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে নিহত হয় ৪ জঙ্গি। আস্তানায় আটকে পড়া ১৮ জনকে নিরাপদে বের করে আনে অভিযানে অংশ নেওয়া সোয়াতের সদস্যরা।

অপারেশন টোয়লাইট : সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমা থানার শিববাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে ‘২৫ মার্চ অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামের অভিযান চালায় সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো টিমের সদস্যরা। প্রথমে এ অভিযান সোয়ট শুরু করলে তার নাম দেওয়া হয় স্প্রিং রেইন। এ অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবির অন্যতম নেতা মাইনুল ওরফে মুসা। ভয়াবহ এ অভিযানে পুলিশ কর্মকর্তা, র্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান আবুল কালাম আজাদ ৫ জন নিহত হন। এছাড়া মুসাসহ তিন নারী জঙ্গি নিহত হয়।

অপারেশন ম্যাক্সিমাস : মৌলভীবাজারের বড়হাটে জঙ্গি আস্তানায় সোয়াতের অভিযান পরিচালনা করে। এ অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’। গত ১ এপ্রিল এ অভিযান শেষ হয়। শেষ হয়েছে। আস্তানার ভেতরে তিন জঙ্গির মরদেহ পাওয়া গেছে। অভিযানে তিন জঙ্গির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ২ জন পুরুষ ও ১ জন নারী রয়েছে। ’

অপারেশন সানডেভিল : রাজশাহীর গোদাগাড়ির নির্জন গ্রাম হাবাসপুরে ১১মে অভিযান শুরু করে কাউন্টার টেরোরিজম। অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন সানডেভিল। এ অভিযানে আব্দুল মতিন নামের ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীকে তেড়ে এসে কুপিয়ে হত্যা করে এক নারী জঙ্গি। তার হুংকারের ভিডিও দেখে অনেকেই হতবাক হয়ে পড়েন। এ ঘটনায় ওই নারীসহ ৪ জঙ্গি নিহত হয়। নিহত সন্দেহভাজন জঙ্গিরা হলেন সাজ্জাদ আলী (৫০), তার স্ত্রী বেলি (৪০), তাদের দুই ছেলে আল আমিন (৩০) এবং সোয়াইয়াদ (২৫)ও মেয়ে করিমা (২৮) ।

অপারেশন আগস্ট বাইট : ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিতে অবস্থান নেয় এক সাইফুল ইসলাম নামের এক জঙ্গি। উদ্দেশ্যে ছিল জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎবার্ষিকী জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মিছিল-সমাবেশের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা। কিন্তু এর আগেই কাউন্টার টেরোরিজম সংবাদ পেয়ে তা ঘিরে ফেলে। পরবর্তীতে তাকে আত্মমর্পণের আহ্বান জানানো হলে সে তার নিজের কাছে থাকা বোমায় আত্মাঘাতী হয়। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন আগস্ট বাইট। এছাড়া ঝিনাইদহ ও রাজশাহীর তানোরে অভিযান পরিচালনা করে কাউন্টার টেরোরিজম। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকদ্রব্য উদ্ধার করে।

‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত মারজান’ : রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার অন্যতম হোতা নুরুল ইসলাম মারজান ও তার সহযোগী সাদ্দাম নিহত হয় ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। নুরুল ইসলাম মারজান নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের একজন ছিল। গুলশানের হলি আর্টিজান, শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন গুপ্তহত্যায় মারজানের নির্দেশ ছিল। মারজানের নিহত হওয়ার ঘটনা জঙ্গি দমনে আরেকটি সফল মাইল ফলক।

এদিকে জঙ্গিদের আগের সেই অবস্থান নেই। মাঝে মধ্যে অনলাইনকেন্দ্রিক সরব হওয়ার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে তারা গ্রেপ্তার হয়ে যায়।

র‍্যাবের মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তারা আর দাঁড়াতে পারবে না। তিনি বলেন, হলি আর্টিজান হামলার পর প্রায় ১৫শ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া বিপদগামী ১৫ জঙ্গি সদস্য আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নব্য জেএমবির ৭০ ভাগ শক্তি কমে গেছে। তাদের পক্ষে এখন বড় হামলা চালানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, পলাতক যেসব জঙ্গি রয়েছে তাদের ব্যাপারে আমাদের তৎপরতা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বড় জঙ্গি হামলার শঙ্কা নেই, সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads