• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে পশুর হাটে

ফাইল ছবি

জাতীয়

মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে পশুর হাটে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৫ জুলাই ২০২২

হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের পণ্যের দাম। মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছেই। এই উত্তাপ পড়ছে কোরবানির পশুর হাটেও। কারণ গত বছরের তুলনায় এবার পশুর দাম অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। বিক্রেতাদের দাবি, গোখাদ্যর মূল্য বৃদ্ধি পশুর অতিরিক্ত দামের অন্যতম কারণ। এছাড়া ‘সবকিছুর দাম বেশি’ এই যুক্তি কিংবা অজুহাতও তুলছেন তারা।

গত জুন মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মে মাসের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে। এত দেখা যায় হঠাৎ মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসে এই হার ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির এত বড় উল্লম্ফন গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি।

সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক হাট ঘুরে দেখা যায়, বিক্রেতারা আড়াই মণ ওজনের গরুর দাম হাঁকাচ্ছেন প্রায় লাখ টাকা। তিন মণ ওজনের গরু দেড় লাখের ওপর, চার মণ ওজনের গরু দুই লাখ বা তার চাইতেও বেশি। ক্রেতারা জানান, গত বছরের তুলনায় গরু প্রতি ন্যূনতম ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেশি দরে গরু কিনতে হবে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের কর। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা অনেক মানুষের আবার গরিব হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে যারা একাই একটি গরু কোরবানি দিয়েছিলেন এবার তাদের অনেকে অন্যজনের সাথে ভাগে গরু কোরবানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকে আবার বিরত থাকছেন পশু কোরবানি দেওয়া থেকেও। জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় তারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানা যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি চাকুরিজীবী বলেন, আগে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে একাই একটি গরু কোরবানি দিতে পারতেন। কিন্তু এখন জীবনযাত্রার ব্যায় বেড়ে যাওয়ায় শেয়ারে কোরবানি দিতে হচ্ছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে প্রস্তুত রাজধানীর পশুর হাটগুলো। পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে হাটগুলোতে। হাটে উৎসুক মানুষের ভিড় থাকলেও নেই তেমন বিক্রি। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা করছেন, আগামীকাল থেকে পুরোদমে শুরু হবে বিক্রি।

গাবতলী গরুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, এ হাটের এখনো চলছে সাজসজ্জার কাজ। এরই মধ্যে গরু বিক্রেতারা তাদের ও গরুর থাকার জায়গা খুঁজে নিচ্ছেন। কেউবা সদ্য নিয়ে আসা গরুগুলোর পরিচর্যা করছেন। দীর্ঘ ভ্রমণ করে আসা নিজেরাও নিচ্ছেন বিশ্রাম। রাজধানীর একাধিক পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, গরুর চেয়ে উৎসুক জনতাই বেশি। এদের বেশিরভাগই এসেছেন গরু দেখতে। গরুর ভিডিও ও কোরবানির হাটে আসা নাদুস নুদুস পশুটিকে সেলফি বন্দি করতে।

মিরপুর মাজার এলাকা থেকে হাটে গরু দেখতে এসেছেন কলেজ শিক্ষার্থী রাজীব আহমেদ। তিনি জানালেন, হাট শুরু হবে আরো দুই দিন পর। তখন হাটে অনেক ভিড় থাকে। এসব বিষয় মাথায় রেখে আগাম হাটে এসেছেন যাতে ভিড় ছাড়াই গরু দেখতে পারেন।

মোহাম্মদপুরের খিলজি রোড থেকে সপরিবারে কোরবানির পশু দেখতে এসেছেন ইমরান আহমেদ। বলেন, এখন তো হাট জমেনি। প্রতি বছর আমার গিন্নী ও বাচ্চারা গরুর হাট কেমন তা দেখতে চায়। তাই তোদেরকে দেখাতে নিয়ে এলাম।

মেহেরপুরের রাসেদ আহমেদ এবার চারটি দেশাল জাতের গরু নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, আগাম আসলাম। যাতে আগে ভাগেই বিক্রি করে চলে যেতে পারি। কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। অনেকে এসে শুধু দেখছে আর দাম জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু কেনার কোনো লোক পেলাম না।
রাজধানীর আফতাব নগর পশুর হাটে এবারের কোরবানি ঈদে ৩০ থকে ৩৫ হাজার গরু বেচাকেনার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৮ থেকে ১০ হাজার গরু এসেছে এ হাটে। এসব গরুর দাম সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা। এই হাটেও গরু থাকলেও ক্রেতাদের উপস্থিতি একবারেই নেই।

হাট কর্তৃপক্ষ বলছে, আজ-কালকের মধ্যে আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার গরু হাটে আসবে। পর্যাপ্ত গরু এলেই ক্রেতারাও হাটে আসতে আকৃষ্ট হবেন, বিক্রিও শুরু হবে। ব্যবসায়ীদেরও প্রত্যাশা আজ-কাল টুকটাক বিক্রি হলেও বুধ ও বৃহস্পতিবার থেকে বিক্রি হবে পুরোদমে।

গতকাল সোমবার রাজধানীর আফতাব নগরে হাটে গিয়ে দেখা গেছে, হাটের বেশিরভাগ জায়গাই ফাঁকা। তবে কিছুক্ষণ পর পর ট্রাকভর্তি গরু হাটে আসছে। ট্রাক থেকে গরু নামানোর পর হাট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাঁশের খুঁটি নিয়ে কেউ কেউ গরু রাখার জন্য গর্ত করে খুঁটি বসাচ্ছেন।
যারা গত দুই-তিনদিন ধরে মাঠে অবস্থান করছেন তাদের কেউ কেউ গরুর রাখার জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। আবার কেউ কেউ গরুকে গোসল করাচ্ছেন কিংবা পানি দিয়ে মুছে দিচ্ছেন। এসময়ে যারা গরু দেখতে এসেছেন তারা দাম জিজ্ঞেস করছেন। দাম যাচাই-বাছাই করছেন। কিন্তু কিনছেন না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিকেলে ক্রেতাদের উপস্থিত বাড়বে।

পূর্ব বাড্ডা থেকে গরু দেখতে আসা মাইনুল হক বলেন, এখন হাট ফাঁকা, সহজেই হাঁটা চলা করা যায়। কিন্তু এক-দুদিন পর আর এই জায়গা দিয়ে চলাফেরা করা যাবে না। তাই আব্বা-আম্মাকে নিয়ে এসেছি। স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছি।

রাখাল আওয়াল হোসেন বলেন, হাট জমছে না। আশা ছাড়িনি। আগামীকাল বুধবার নাগাদ জমবে হাট। তিনি বলেন, গত বছর তো আগেভাগেই বেশ কিছু গরু বেঁচে দিয়েছিলাম। এবার এখনো কেনার মতো ক্রেতার দেখা পাইনি। অনেকেই আসে ছবি তোলে, দাম-দর করে চলে যায়। আর উৎসুক জনতা তো আছেই।

চুয়াডাঙ্গার আলম নগর থেকে পাঁচটি গরু নিয়ে আসা আহাদ আলী বলেন, এবার পাঁচটি এনেছি। ১৬ লাখ টাকা হলে বিক্রি করে দেব। পুরোনো এই ব্যবসায়ী বলেন, এবার চেপে ধরে রাখব না, বিক্রি করে চলে যাব।

তিন বছর ধরে এই হাটে গরু বিক্রি করতে আসা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন বলেন, এবার ২৩টি গরু আনছি। ৫০ হাজার ৬০ হাজার টাকা লাভ হলেই বিক্রি করে চলে যাব। দৌলতপুরের এই ব্যবসায়ী বলেন, দুদিন হলো এখনে এসেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ক্রেতার দেখা পাইনি।

মেহেরপুরে ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, দুদিনে ২৭টি গরু এনেছি। এবার ১০০টি গরু হাটে আনব। বাকি গরু কাল-পরশু চলে আসবে। তিনি বলেন, আমরা গরুগুলো গত দুই তিন মাস ধরে এলাকা থেকে কিনেছি। আমাদের গরুগুলো দেশি ও ছোট, তবে লাখ টাকার নিচে কোনো গরু নেই।
এবার পশুর হাটগুলোতে ক্রেতাদের দৃষ্টি কাড়তে বড় আকারের গরুগুলোর দেওয়া হয়েছে বাহারি সব নাম। হাটে আসা ক্রেতা কিংবা দর্শনার্থীদের আকর্ষণ এসব বিশাল আকৃতির গরুগুলোর দিকে। আফতাব নগর পশুর হাটে আসা বড় গরুর মধ্যে রয়েছে চাঁদপুরের ‘মুন্না ভাই’। ব্রাহমা জাতের ষাঁড়টির ওজন ১১শ কেজি। দাম হাঁকানো হচ্ছে ১১ লাখ টাকা। কুষ্টিয়ার মিরপুর থেকে আসা ‘শেহের খানের’ দাম হাঁকানো হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান গরুটির ওজন ৪০ মণ। মাংস হবে ৩০ মণ। এছাড়াও ‘কালো মানিক’ ১০ লাখ, ‘বস’ ৮ লাখ, ‘লাল মানিক’ ৮ লাখ, ‘রশিদ বাবু’র ৬ লাখ টাকা দাম হাঁকানো হচ্ছে। এসব বড় গরু এ হাটে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে বলে জানায় হাট কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে রাজধানীর স্থায়ী পশুর হাট গাবতলীতে ১১টি গরু নিয়ে ঝিনাইদহের গোপালপুর থেকে এসেছেন সুমন হোসেন। এ ১১টির মধ্যে আকর্ষণের কেন্দ্রে তিনটি গরু। নাম বিগ শো, বাংলার ডন ও বাংলার বস। একেকটির দাম হাঁকানো হয়েছে ২০ লাখ। তিনটি মিলে দাম হাঁকানো হয়েছে ৫০ লাখ। তবে একেকটি ১৫ লাখে বিক্রির আশা বেপারি সুমন হোসেনের।

আফতাব নগর পশুর হাটের ইজারাদার মিজানুর রহমান ধনু বলেন, গত বছর হাটে ৪০ হাজার গরু এসেছিল। এর মধ্যে ২৫-৩০ হাজার বিক্রি হয়েছিল। ১০-১৫ হাজার অবিক্রিত ছিল। এবার আমাদের টার্গেট ৩০-৩৫ হাজার গরু কেনা-বেচার। তিনি বলেন, এখনও ক্রেতাদের উপস্থিতি কম। কাল-পরশু থেকে জমবে হাট। কেনা-বেচা শুরু হবে। ধনু বলেন, এবার ১৫টি হাসিল রাখা হয়েছে। গরুগুলোর অবস্থা দেখার জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসক রয়েছে। আমাদের স্বেচ্ছাসেবক কর্মী রয়েছে। যখন যাদের যা প্রয়োজন ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads