• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ১২ আগস্ট ২০২২

অপরাধীদের অভয়ারণ্য কক্সবাজারের উখিয়ায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদক পাচার, চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তারা। অভিযোগ উঠেছে, অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। তাই ড্রোন ক্যামেরা এবং ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। জানা গেছে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে ১০১টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে মে মাসে দেশব্যাপী শুরু মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২৭৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৯ জন। নিহত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিনজন নারীও ছিলেন।

সবশেষ উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই রোহিঙ্গা নেতা নিহতের ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ বিষয়ে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (এসপি) মোহাম্মদ শিহাব কায়সার জানান, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলো সাহ মিয়া (৩২), মো. সোয়াইব (১৯) ও জাফর আলম (৫৪)। তিনজনই হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

জানা গেছে, ৩২টি শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ অপরাধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে উঠে আসছে রোহিঙ্গাদের নিত্যনতুন এ অপরাধের চিত্র। এসব অপরাধ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে শিবিরগুলোতে ১০১টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এসব অপরাধী কর্মকান্ডের ঘটনা স্বীকার করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। মুঠোফোনে তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের নিজস্ব কারণে খুনোখুনিগুলো হচ্ছে এবং তার প্রভাব কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও পড়ছে। তবে ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ কামরান হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে পূর্বশত্রুতার জের ধরে ৮ থেকে ১০ জন দুষ্কৃতকারী পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের মতের সঙ্গে এক মত প্রকাশ করেন। ক্যাম্পে ব্লক অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান।

রোহিঙ্গারা শুধু নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি নয়, রোহিঙ্গাদের হামলায় কয়েকজন বাংলাদেশিও নিহত হয়েছে। পাশাপাশি অপহরণের শিকারও হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা হলো উখিয়া এবং টেকনাফে এখন রোহিঙ্গারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশিরা সেখানে এখন সংখ্যালঘু। সে কারণেই শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি কতদিন নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে সে উদ্বেগ রয়েই যাচ্ছে স্থানীয়দের মাঝে। তাই প্রত্যাবাসনে যতো বেশি সময় লাগবে, ক্যাম্পের পরিস্থিতি ততোই খারাপ হবে বলে ধারণা করছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল।

সর্বশেষ গত দুই-আড়াই মাসে মিয়ানমার ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) ২ নেতাসহ অন্তত পাঁচজন খুন হয়েছে। এদের মধ্যে গত মঙ্গলবার (১ আগস্ট) বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে নুরুল আমিন (২৬) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক খুন হয়।
অপরাধের আখড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প

জানা গেছে, ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশনের আই ব্লকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। মৃত নুরুল আমিন ওই ক্যাম্পের আবু শামার ছেলে।

গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা ও তাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে নিহতের পরিবারের সদস্যরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসাকে দায়ী করে আসছিল। এরপর ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে গুলি করে ছয়জন ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এসব বড় ঘটনার পরেও একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না। এমনকি রোহিঙ্গা শিবিরে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মির (আরসা) উপস্থিতির বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এলেও এতো দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়। সর্বশেষ ১৩ জুন পুলিশের দেয়া রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী শিবিরে আরসা সদস্যদের উপস্থিতি স্বীকার করে পুলিশ।

ওই তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, মুহিব উল্লাহকে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। মুহিব উল্লাহ আরসা প্রধানের চেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে যাচ্ছিলেন বিধায় তাঁকে হত্যা করে আরসার সদস্যরা। মুহিব উল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের কারণে আরসার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

ক্যাম্পের ভেতরে দিনের বেলায় এক রকম চিত্র থাকলেও রাতের বেলায় চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। দিনে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল থাকলেও রাতে অরক্ষিত থাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তাই রাতের আঁঁধার নামার সাথে সাথেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয় বলেও জানান শরণার্থী যুবক ওসমান।

ক্যাম্পের ভেতর ২০টির বেশি সংঘবদ্ধ দলের খবর জানিয়েছে একটি সূত্র। তবে আরসা বা হারাকা আল ইয়াকিন, আরএসও, ইসলামী মাহাজ সংগঠনের নামে এক ধরনের তৎপরতার খবর পাওয়া যায় উল্লেখ করে ওই যুবক বলেন, এর বাইরেও মুন্না গ্রুপ, হাকিম ডাকাত বাহিনীর মতো কিছু অপরাধী দল আছে বলে শোনা যায়। যারা মাদক চোরাচালান, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে ১১ লাখের বেশি আশ্রিত মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণ বনভূমি ও পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তারা গাছ কাটার মাধ্যমে বনভূমি হ্রাস এবং এলাকার পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর ৪৫ হাজারের বেশি শিশুর জন্মগ্রহণ করছে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দিয়েছে। সরকার এক লাখ রোহিঙ্গাকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়ার জন্য ভাসানচরকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তুলেছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads