• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
দুর্দশা বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

দুর্দশা বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ২০ আগস্ট ২০২২

মো. রমজান আলী। বয়স ৪০-এর কাছাকাছি। পেশায় রিকশাচালক। ১২ বছর ধরে রাজধানীতে রিকশা চালাচ্ছেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সরকার। কড়াইল বস্তিতে থাকেন তিনি। প্রতিদিন রিকশার মালিককে ভাড়া পরিশোধ করার পরে মাসে গড়ে আয় হয় ১৩ হাজার টাকা। এ দিয়ে বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল দিয়ে ছোট পরিবার চালানো বর্তমানে কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রিকশা চালান শুরু করি। সকাল ১০টার দিকে রাজধানীরে কোনো রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে ১টা কলা ও একটা বন রুটি খেয়ে নাস্তার কাজ শেষ করতে হয়। দুদিন আগেও ৫ টাকায় একটা কলা পাওয়া যেত, এখন সেই কলা ১০ টাকা থেকে ১২ টাকা। দুদিন আগে বন রুটি ৫ টাকায় পাওয়া যেত। সেই রুটি এখন ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা। দুপুরে ফুটপাতের হোটেলে আলু বস্তা, ডাল আর এক প্লেট ভাত ২৫ টাকায় খাওয়া যেত। সেই ভাত এখন থেকে খেতে হচ্ছে ৮০ টাকা প্লেট। এভাবে আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে বেশি দাম দিয়ে চলতে হচ্ছে।
কিন্তু আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে পারি না। বরং ২০ টাকার ভাড়া কোন কোন জায়গায় ৩০টা থেকে ৪০ টাকা নিয়ে থাকি। অনেক সময় বেশি ভাড়া দাবি করলে কোন কোন যাত্রী খারাপ আচরণও করে থাকেন। আবার কোন কোন যাত্রীর হাতে মারও থেকে হয়।
তিনি বলেন, এখন অবস্থা আরো খারাপ। ‘বাধ্য হয়ে’ এখন ‘কম খাওয়ার’ নীতি গ্রহণ করেছি। আগে আমার বাসায় এক বেলা রুটি ও দুই বেলা ভাত রান্না হতো। এখন শুধু এক বেলা ভাত খাওয়া শুরু করেছি। ‘কথাগুলা কইতে খারাপ লাগতাছে, গত এক মাস ধইরা আমার বাসায় শুধু রাইতে ভাত রান্না হয়। বাকি দুই বেলা হালকা কিছু (খাবার) খায়ে কাটায়া দেই। এর আগে এত সমস্যায় পড়ি নাই। এখনকার অবস্থা বলার না।

এদিকে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি করেন আলমাস আলী। বেতন পান ৮ হাজার টাকা। আগে পরিবার নিয়ে সস্তা একটি টিন সেডের বাসায় থাকতেন। খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি এখন একটি মেসে থাকেন। নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতে পাঠানোর মতো টাকা থাকে না তার। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছিল। এরপর করোনার প্রকোপ কিছুটা কমলে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
কিন্তু এরপরই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তাই ফের বাড়তে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম আবার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে বাজার। প্রায় সবধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায় হু-হু করে। গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ করে দেয় সরকার। এর ফলে আরো বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। পরিবহন খরচ বাড়ার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।
গতকাল শুক্রবার সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারে দেখা যায়, মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা প্রতি কেজি আর মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭২ টাকা। অথচ এই চালই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে বিক্রি হয়েছিল যথাক্রমে ৫৫ থেকে ৭০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে তিন টাকা।
মো. মিজানুর রহমান নামে অবসর প্রাপ্ত এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, দুদিন আগে প্রতি কেজি চিকন চাল বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা। সেই চাল গতকাল শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। অর্থাৎ কেজি প্রতি ৫ টাকা বেড়েছে। শুধু চিকন চাল নয়, সব ধরনের চাল ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এভাবে বেশি সমস্যা হচ্ছে নিম্নবিত্ত মানুষের। তারা এখন কি করে সরকার চালাবেন এ বিষয়ে সরকার কিছুই বলছেন না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সারা দেশে মিলে মজুত আছে হাজার হাজার টন চাল। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা জ্বালানি তেলে মূল্য বৃদ্ধি অজুহাতে ইচ্ছে মতো চালের দাম বাড়িয়েছে। এ জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করছে খুচরা ব্যবসায়ীরা।

কথা হয় খিলগাঁও কাঁচাবাজারের চাল ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। এখন তার আশঙ্কা চালের দাম ‘আরো বাড়বে’। তিনি বলেন, গত দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতি কেজি মোটা ও মিনিকেট চালের দাম ৩ টাকার মতো বাড়ছে। গতকাল শুক্রবার আড়তে কথা বললাম। আড়তদার জানাইলো আগামীকাল থিকা মিনিকেট চাল কিনতে হইবে ৭২ টাকা কেজি। অর্থাৎ আড়তেই যদি আমাগো ৭২ টাকা কিনতে হয় তাইলে দুই-তিন টাকা লাভে বিক্রি করতে হইবো। দাম আরো বাড়বো। কেন দাম বাড়ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আড়তদাররা কয়, পরিবহন খরচ বেড়েছে। তারা বাড়তি দামে চাল কিনছে। আমাদের কাছেও বাড়তি দামে বিক্রি করতেছে।
একইভাবে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সবগুলো নিত্যপণ্যের দাম হু-হু করে বাড়ছে। গতকাল মশুর ডাল (চিকন) বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৪০ টাকায়, এক সপ্তাহ আগে যা ছিল ১৩৫ টাকা। আটা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৪৫ টাকা। সয়াবিন তেল (বোতলজাত) প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৮৫ টাকা। পেঁয়াজ ৫০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৪০ টাকা। আলু বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩০ টাকায়, আগে ছিল ২৫ টাকা। চিনি ছিল ১০০ টাকা যা মাত্র দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ৮০ টাকায়। এভাবে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছে দাম আরো বাড়বে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশর অফ বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম ৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও দাম বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মে মাস থেকে মূল্যম্ফীতি ৭ শতাংশের ওপরে রয়েছে। মে মাসে মূল্যম্ফীতি উঠেছিল ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশে, যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এই অবস্থায় যেকোনো মূল্যেই হোক, সরকারকে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলে বলছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তাতে স্বল্পআয়ের মানুষের খেয়ে-পরে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে যাবে। সরকার যদি দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তাহলে অন্য অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যাবে।

তবে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৪ টাকা থেকে ৫ টাকা বৃদ্ধি অযৌক্তিক বলছেন বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সি। তিনি বলেছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে দাম বেশি বাড়িয়ে দেয়। পরিবহন খরচ যেখানে বেড়েছে কিলোমিটার প্রতি মাত্রা ৫০ পয়সা, সেখানে ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি পণ্যে দাম বাড়িয়ে দেয় ৪ টাকা। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে সরকার কাজ করছে বলে তিনি জানান। প্রতিটি জেলায় প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করছে সরকার। দাম বাড়ার চাপে জেরবার সাধারণ মানুষের দুর্দশা বেড়েই চলেছে। চাল, আটা, প্রভৃতির দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে বেড়ে যাওয়ার ঘানি যে টানতে হবে সেটা মানুষ জানে। কিন্তু বাজারে গিয়ে পণ্যের দাম শুনে তারা বিস্ময় মানছে। সাধারণ মানুষের এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন? বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই প্রশ্ন করে বসেছেন। তিনি বলেছেন, চালের দাম ৪ টাকা বাড়ে কোনো যুক্তিতে। তার ভাষ্য, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে চালের দাম প্রতি কেজিতে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা বাড়তে পারে।

বাণিজ্যমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন। এর আগেও তিনি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তবে অভিযোগ করে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার চেষ্টা করছে- এমন বক্তব্যও কাজে আসেনি। শুধু মুখের কথায় চিড়ে কখনো ভেজে না।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads