• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ভয়ানক ২১ আগষ্টের ১৮তম বর্ষ আজ

নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২১ আগস্ট ২০২২

আজ সেই ভয়ানক দিন ২১ আগস্ট। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরো একটি কলংকের দিন। বঙ্গবন্ধুর পর তার উত্তরসূরি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার দিন। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আজ থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৪ সালের এইদিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও  তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত পৈশাচিক ওই হামলায় প্রাণ হারিয়ে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী বেগম আইভী রহমানসহ ২৪ জন। আর আহত হয়েছিলেন প্রায় চারশ নেতা-কর্মী। এদের অনেকেই এখনো শরীরে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন আওয়ামী লীগের ২০ জন নেতা-কর্মী।

তবে নারকীয় হামলায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা পেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে তিনি কিছুটা সুস্থ হলেও আজো সেই স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আহতদের অনেকেই পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছেন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সারা দেশে বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিকাল ৪টার দিকে সমাবেশ শুরু  হয়। সমাবেশের পর শোক মিছিলের কর্মসূচি ছিল। বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা বিকাল ৫টার দিকে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। তিনি বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ জিপ থেকে নেমে নিরাপত্তাকর্মী বেষ্টিত অবস্থায় একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে উঠে বক্তৃতা শুরু করেন। বক্তৃতায় দেশব্যাপী অব্যাহত বোমা হামলার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

২০ মিনিটের বক্তৃতা শেষে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে দক্ষিণ দিক থেকে মঞ্চকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। গ্রেনেডটি মঞ্চের পাশে রাস্তার ওপর পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। পরে একে একে আরো ১২টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। এতে মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এ সময় কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতৃবৃন্দসহ দলীয় নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গাড়িতে করে সুধাসদনে নিয়ে যাওয়া হয়। শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়ির ওপরও গুলিবর্ষণ করা হয়। নিক্ষিপ্ত তিনটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত থেকে যায়।

উপর্যুপরি বোমা হামলায় হতাহতদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন দলের নেতা-কর্মীরা। তারা গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ জানাতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর প্রথমে বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও পরে কাঁদানে গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করে। এতে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ নিরীহ পথচারীদেরও লাঠিপেটা করে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, স্টেডিয়াম মার্কেট, বায়তুল মোকাররম মার্কেট, নবাবপুর রোড, নর্থ সাউথ রোড, পুরানা পল্টনসহ আশপাশের এলাকার দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। লোকজন আতংকে এলাকা ছেড়ে পালাতে থাকে।

হতাহতের মধ্যে তিন শতাধিক নেতা-কর্মীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, আরো শতাধিক নেতা-কর্মীকে অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

মূলত এর পেছনে কাজ করেছে নানা স্বার্থবাদী অপচিন্তা। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে এ সংক্রান্ত মামলা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে নানাভাবে। ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে অনেক তথ্যও। জজ মিয়া নামের এক নিরীহ ব্যক্তিকে আটক করে তার কাছ থেকে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করে ঘটনার প্রকৃত কুশীলবদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয় দফার তদন্তে বেরিয়ে আসে, তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইন্ধনে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি)সহ তিনটি জঙ্গি সংগঠন ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।

ভয়াবহ সেই ঘটনার ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ মামলার রায় ঘোষিত হয়। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং বাকি ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন : ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল। যদিও ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি।

চার্জশীট অভিযোগপত্র : দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৯ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। ওই বছরই মামলা দুটির কার্যক্রম দ্রুত বিচার আদালত-১-এ স্থানান্তর করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের ২৯/১১ (হত্যা) ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

অধিকতর তদন্তের আবেদন ও সম্পূরক চার্জশীট : ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা ১২ আগস্ট মঞ্জুর করেন। এর পর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আখন্দ।  তদন্ত শেষে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয় ২০১১ সালের ২ জুলাই। তাতে তিনি তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন ।

আসামিদের মধ্যে ৩৮ জন উভয় মামলায়ই আসামি। এর মধ্যে এখন হত্যা মামলায় ৪৯ জন ও বিষ্ফোরক আইনের মামলায় ৩৮ জন আসামি। এ মামলার মোট ৫ শ ১১ জন সাক্ষী। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষে ২২৫ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেয়।

আসামি গ্রেপ্তার ও পলাতক : ২১ আগস্টের ঘটনায় পৃথক মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৫২ জন। এর মধ্যে ৩ জন আসামির অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাদেরকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ৩ আসামি হলেন-জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ সাহেদুল আলম বিপুল।

এখন পর্যন্ত ৪৯ আসামির বিচার হয়েছে। এর মধ্যে এখনো ১৭ জন পলাতক। এখন ৩১ আসামি কারাগারে রয়েছেন। এরমধ্যে মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ধার্যের দিন পর্যন্ত ৮ আসামি জামিনে ছিলেন। ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়। আসামিরা হলেন- বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদ, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম। কারাগারে রয়েছেন ৩২ জন। বাকি ১৭ জন হলেন, মাওলানা তাজউদ্দিন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা সাবেক এমপি শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, ব্যবসায়ী মো. হানিফ, মহিবুল মুত্তাকীন, আনিসুল মুরসালিন, মুফতি শফিকুর রহমান, রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু, জাহাঙ্গির আলম বদর, মো. খলিল, মাওলানা লিটন ও মুফতি আবদুল হাই। সাবেক সেনা কর্মকর্তা এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান খান ও খান সাঈদ হাসান।

আলোচিত জজ মিয়া : ভয়াবহ এ হামলা মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে ২০০৫ সালের ৯ জুন জজ মিয়াকে আটক করা হয়। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে নেওয়া হয় সেনবাগ থানায়।

পরবর্তীতে সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। পরে তদন্তে আসে ‘জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো নাটক।’

এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads