• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
সীমালঙ্ঘন করছে মিয়ানমার

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

সীমালঙ্ঘন করছে মিয়ানমার

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী সশস্ত্র আরাকান আর্মি ও মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ের ঘটনার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। বান্দরবান সীমান্তে গুলির শব্দে আতঙ্কিত বাসিন্দারা। প্রথম দফায় গুলি ও মর্টার পড়ার ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানানো হলেও আমলে নিচ্ছে না মায়ানমার। গতকাল শনিবারও হেলিকাপ্টার থেকে মর্টার এসে পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।

স্থানীয়রা বলছেন, আরাকানে আবারো রোহিঙ্গা নিধনে নেমেছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াইয়ের ধুয়ো তুলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে চায়। এ কারণে আবারো বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করছে। এমনকি বাংলাদেশসহ মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ২টি গোলা বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে পড়েছে। সকাল সাড়ে ৯টায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপি আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১ এর মাঝামাঝি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সকাল সাড়ে ৯টায় রেজু আমতলী বিজিবি বিওপি আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১ এর মাঝামাঝি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমান এবং দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার আগমন করে। এ সময় যুদ্ধবিমান থেকে আনুমানিক ৮ থেকে ১০টি গোলা ফায়ার করা হয় এবং হেলিকপ্টার থেকেও আনুমানিক ৩০-৩৫টি ফায়ার করতে দেখা যায়।

সীমান্ত পিলার ৪০ বরাবর আনুমানিক ১২০ মিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিমান থেকে ফায়ারকৃত দুটি গোলা পতিত হয়।

এছাড়া নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ১নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু বিজিবি বিওপির সীমান্ত পিলার ৩৪-৩৫ এর মাঝামাঝি মিয়ানমার ২ বিজিপির তুমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকে চার রাউন্ড ভারী অস্ত্রের ফায়ার করে যা এখনো চলমান। এমনকি মিয়ানমার মুরিঙ্গাঝিরি ক্যাম্প ও তুমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকে থেমে থেমে মর্টার ফায়ার চলমান।

এদিকে এসব ঘটনায় আতঙ্কে দিন পার করছেন সীমান্তের এপারে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের বাসিন্দারা। গত প্রায় একমাস ধরে এ গোলাগুলি চলছে।

উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখা এবং ওই দেশের সীমান্তবর্তী ১৬ কিলোমিটার এলাকায় চলছে তুমুল গোলাগুলি ও গোলাবর্ষণ। এসবের শব্দে কেঁপে উঠছে ঘরবাড়ি। এরই মধ্যে মায়ানমারের মর্টারশেল এসে বাংলাদেশের সীমান্তে পড়ছে। হেলিকাপ্টার দিয়ে গুলিবর্ষণের পাশাপাশি মর্টারশেল বাংলাদেশ সীমান্তেও এসে পড়ছে। যার কারণে চরম আতঙ্কগ্রস্ত সীমান্তের বাসিন্দারা। এমন পরিস্থিতিতে তীক্ষ দৃষ্টিও রাখছে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন।

জানা গেছে, ঘুমধুমের তুমরু গ্রামের পূর্বাংশের শূন্যরেখায় থাকা ৫ হাজার রোহিঙ্গারা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ, ঘটনাস্থলের খুব কাছেই অস্থায়ী ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তাঁরা। যার ৫০ গজের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর যাতায়াত সড়ক। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমাবর্তী অন্তত ২০ গ্রামের মানুষ রাতে ঘুমাতে পারে না গোলার আওয়াজে।

সীমান্তবাসী বলছেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির সঙ্গে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এ গোলাগুলি হচ্ছে। তারা একে অপরের উদ্দেশে মর্টারশেলসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে।

সীমান্তের রেজুআমতলী, গর্জনবুনিয়া, বড়ইতলী সোনাইছড়ি ও আমতলীর বাসিন্দা, ক্যাচালনং তংচংগা, ফরিদুল আলম, মো. ইদ্রিস, উচালা মার্মা ও জোবেদা বেগমসহ অনেকে জানান, গত প্রায় একমাস ধরে মায়ানমার বর্ডারের দিকে বিকট গুলির আওয়াজ শুনতে পান তারা। এমনকি মর্টারশেলের আওয়াজ তাদের আতঙ্কিত করে। সীমান্তের ৩৮ নম্বর পিলার থেকে ৪১ নম্বর পিলার পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকায় এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।

এসব বাসিন্দা আরো জানান, নানা মাধ্যমে তারা শুনেছেন, মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরকান আর্মির মধ্যে এ গোলাগুলি চলে; যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখা ও মায়ানমারের ওপারের এলাকায় হয়। আরাকান আর্মি চায় আরাকানের স্বাধীনতা। আর মায়ানমারের সরকারি বাহিনী চায় তাদের শায়েস্তা করতে। এ নিয়ে তাদের সংঘাত চলে আসছে সেই কয়েক যুগ ধরে।
তারা বলছেন, এসব ঘটনায় রোহিঙ্গা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে চলে আসার চেষ্টা করছে। যেকোনো মুহূর্তে তারা ঢুকে পড়তে পারে। মূলত রোহিঙ্গা নিধনের জন্যই মায়ানমার এ অভিযান চালাচ্ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কালাম সাংবাদিকদের বলেন, আমার বাড়ি আজুখাইয়া এলাকায়। সীমান্ত থেকে ৫ কিলোমটির দূরে। তবু গোলাগুলির আওয়াজে আমাদের ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে। বর্তমানে মায়ানমার সর্বোচ্চ সীমালঙ্ঘন করে চলেছে। প্রতিনিয়ত সীমান্তের এপারে গুলি আসছে। পরপর দু’বার মর্টারশেল পড়ার ঘটনাও ঘটলো।

ঘুমধুম রেজু রড়ইতলী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উৎপল বড়ুয়া বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে মিয়ানমার থেকে ভারী অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। এতে এলাকার লোকজন আতঙ্কিত। তবে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) নিয়মিত টহল দিচ্ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, আমি কদিন ধরে মায়ানমার সীমান্তে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। পর পর দু’বার মর্টারশেল এসে পড়লো আমাদের দেশের অভ্যন্তরে। এ ঘটনায় একদিকে আতঙ্ক বাড়ছে অন্যদিকে সীমালঙ্ঘন করে চলেছে মায়ানমার।

তিনি আরো বলেন, মায়ানমার সেনাবাহিনী যে ধরনের আক্রমন তারা শুরু করেছে ২০১৭ সালের মতো দেশে আবারো রোহিঙ্গা ঢল নামতে পারে। প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা এ এলাকায় রয়েছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা শুনতে পাচ্ছি তারা বাংলাদেশে আসারও চেষ্টা করছে পাশাপাশি মালয়েশিয়াতেও প্রবেশ করার অপেক্ষাতে রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা সরওয়ার আলম বলেন, গত রোববার বিকেলে বিকট শব্দে মর্টারের গোলাটি উত্তরপাড়ার আয়াজের বাড়ির কাছে এসে পড়ে। এর এক সপ্তাহ পার না হতে আবারো তারা গোলা নিক্ষেপ করলো।

তিনি আরো বলেন, সীমান্তুজুড়ে চরম আতঙ্ক চলছে। মায়ানমার সেনাবাহিনী একের পর এক উস্কানি দিয়ে চলেছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ সাংবাদিকদের আরো জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে ওপারে গোলাগুলি হচ্ছে এতদিন পাহাড়ে গোলা ছুড়লেও পর পর দুই বার মর্টারশেলগুলো পড়ায় স্থানীয়রা আতঙ্কে আছে।

তিনি আরো বলেন, মর্টারশেল পড়ার পর হেলিকাপ্টার থেকে যে গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে সেগুলোও সীমান্তের এপারে আমাদের এলাকায় পড়ছে। যার কারণে আমাদের স্থানীয়দের আতঙ্কে দিন কাটছে।

এদিকে মর্টারশেল পড়ার ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মোকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে একটি মৌখিক নোটও দেওয়া হয়। গত সোমবার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।
পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহারিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মায়ানমারের উস্কানিতে পা দেব না। তবে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিজিবিকে। এমন বক্তব্যের তিনদিন পরেই আবারো মর্টারশেল পড়ার ঘটনা ঘটলো।

বান্দরবান পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্তের এপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কবস্থায় রয়েছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তথ্যটা পেয়েছি। পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ সতর্কবস্থায় আমরা রয়েছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads