জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক:
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ও পরে দেশের বেশ কিছু থানায় দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। দেওয়া হয় আগুন। থানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যায় তারা। বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারও এ সময় দেখা গেছে। এছাড়াও গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায়ও দেওয়া হয়েছে অনেক অস্ত্রের লাইসেন্স। এসব বৈধ অস্ত্র অবৈধ কাজে ব্যবহার রোধে লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি নির্দেশনার পরেও ৪৬ হাজার অস্ত্র জমা দেননি লাইসেন্সধারীরা। এসব অস্ত্র দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্ন ঘটাতে পারে, এ বিবেচনায় আজ রাত থেকে দেশব্যাপী শুরু হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান।
থানা থেকে অস্ত্র ও গোলা বারুদ লুট, সহিংস ঘটনা, জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনিভাবে তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধ, ঢালাওভাবে মামলা ও গ্রেফতার না করার জন্য সতর্কতা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়াও দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চোরাচালানি ও মাদকের গডফাদারদের ধরতে আজ রাত ১২টা থেকে যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক শেষে এ কথা বলেন তিনি।
উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, সভাটি ছিল আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা। এ সভায় প্রধানত দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা হয়েছে। কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করা যায় সে সব নিয়ে কথা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা কিছু কিছু পদক্ষেপ নেব। সব বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গতকাল। আগামীকাল (আজ) থেকে আমাদের যৌথবাহিনীর অপারেশন শুরু হবে হাতিয়ার কালেকশনের জন্য। আমরা যেন অবৈধ অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করতে পারি। আমি এ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতা চাই।
উপদেষ্টা বলেন, মাদক আমাদের বড় সমস্যা। আমরা কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য খুবই জরুরি। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। মাদকের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি।
তিনি আরো বলেন, আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। পূজা যেন ঠিকভাবে হতে পারে সে বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা আশা করছি পূজাটা খুব ভালোভাবে শেষ হবে। কোথাও কোনো সমস্যা হবে না। মিয়ানমারের সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি সেটা অনগ্রাউন্ড দেখতে পাবেন।
অপরদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হযেছে, কোনোভাবেই কোনো প্রতিষ্ঠান ঘেরাও বা সহিংস আচরণ করা যাবে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবাদের নামে প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনিভাবে তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ করার বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন হলে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বগ্রহণ করে। গণঅভ্যুত্থান দমন করতে পতিত সরকার নিষ্ঠুর বল প্রয়োগ করলে বহু প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিনের দুঃশাসনে বহু মানুষ অপহরণ, গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এতে করে বিদায়ী সরকারের প্রতি জনমনে প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজমান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব নিপীড়নের বিচার করতে বদ্ধপরিকর। উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সরকার যখন বিচারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে জাতিসংঘকে সত্য অনুসন্ধানে আহ্বান জানিয়েছে এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, ঠিক সেই সময়ে কিছু অতিউৎসাহী এবং স্বার্থান্বেষী মহল আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবাদের নামে প্রতিষ্ঠান ঘেরাও, জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বেআইনি তল্লাশি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ঢালাওভাবে মামলা গ্রহণে পুলিশের ওপর চাপ প্রয়োগ ও আদালতে আসামিকে আক্রমণ করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে সরকার সবাইকে আশ^স্ত করতে চায় যে, মামলা হওয়া মানেই যত্রতত্র গ্রেপ্তার নয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে যে, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকার সব দুষ্কৃতকারীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযান চালাবে এবং দল-মত নির্বিশেষে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দপ্তরে জানাতে হবে, কোনোভাবেই কোনো প্রতিষ্ঠান ঘেরাও বা কোনো রকম সহিংস আচরণ করা যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে তল্লাশি ও মামলা গ্রহণে প্রচলিত আইন যথাযথভাবে মেনে চলা হবে এবং হয়রানিমূলক পদক্ষেপ দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে আহবান জানানো হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী সরকারের ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈধ অন্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে তার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এর মধ্যে ১০ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হাতে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকরা বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করেন। ছাত্র আন্দোলন দমাতে এসব অস্ত্র ব্যবহার করার ও তথ্য পাওয়া গেছে। কখনো কখনো অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে পরে সেটিকে বৈধ অস্ত্র বলে দাবির ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশির ভাগ সময়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নিশ্চুপ ভূমিকায় থাকতে দেখা গেছে। এখনো বৈধ অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ৪৬ হাজার অস্ত্র জমা পড়েনি বলেও জানা গেছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে সব বাহিনীর সমন্বয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান চলবে।
‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬’ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নিজের লাইসেন্সের বিপরীতে নেওয়া অস্ত্র শুধু আত্মরক্ষার জন্য বহন ও ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যের ভীতি বা বিরক্তি তৈরি হতে পারে, এমন ক্ষেত্রে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এটা করলে তাঁর অস্ত্রের লাইসেন্স তাৎক্ষণিকভাবে বাতিলযোগ্য হবে।
লুট হওয়া ৩৮৮০টি অস্ত্র উদ্ধার : পুলিশ সদর দপ্তর
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন থানায় অগ্নিসংযোগ ও হামলে করে। থানা ও ফাঁড়িতে হামলার পর অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের রোববারের তথ্যানুযায়ী, লুট হওয়া ৩৮৮০টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৩ হাজার ৮৮০টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ২ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গুলি, ২২ হাজার ২০১ টিয়ার শেল এবং ২১৩৯ সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে।