• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪৩ লাখ মানুষ

সংগৃহীত ছবি

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪৩ লাখ মানুষ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৩ জুন ২০২২

দেশে চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রায় ৪৩ লাখ মানুষ। এর মধ্যে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে ১৬ লাখ শিশু। যদিও গত দুই দিন ধরে সিলেট অঞ্চলে নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। কিন্তু উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে এখনো বাড়ছে পানি। তাই বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বেসরকারি ও সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণ কার্যক্রম চললেও শুরু হয়নি পুনর্বাসনের কার্যক্রম। তবে সরকারিভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে রয়েছে গরমিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষয়ক্ষতির হিসাবের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা ও পুনর্বাসনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি হিসাবে গরমিল থাকলে এ কার্যক্রমে জটিলতা দেখা দিতে পারে।

জাতিসংঘের বন্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের আকস্মিক বন্যায় সুনামগঞ্জের ৯৪ শতাংশ এবং সিলেটের ৮৪ শতাংশের বেশি জায়গা প্লাবিত হয়েছে। এতে আনুমানিক ৪৩ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষত্রিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বন্যার পানিতে আনুমানিক ১০ হাজার হেক্টর জমির শাকসবজি, তেল বীজ এবং অন্যান্য ফসল প্লাবিত হয়েছে।

অন্যদিকে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলমান বন্যায় দেশের পাঁচ বিভাগের ১৫টি জেলার ও ৯৩টি উপজেলার ৬৭ হাজার ৬১০টি মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন। এতে খামারিদের ক্ষতি হয়েছে ১৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এছাড়াও অবকাঠামো গত ক্ষতি হয়েছে ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক জানান, এটি ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব। এরপর প্রতিদিনই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরও সময় লাগবে।

সিলেট ও উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বন্যাদুর্গত মানুষ পার করছেন কঠিন সময়। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয়ের (ইউএন ওসিএইচএ) সর্বশেষ বন্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বর্ষা এবং উজান থেকে আসা পানি সিলেট বিভাগের বিশাল অংশ প্লাবিত করেছে। লক্ষাধিক মানুষ জলাবদ্ধ হয়ে পড়ায় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আকস্মিক বন্যা বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এতে দুর্গত পরিবারগুলোকে উঁচু জমিতে এবং অস্থায়ী বন্যার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে যখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল তখন এসব মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।

প্রতিবেদনে জাতিসংঘ আরো জানায়, হবিগঞ্জের ৪৫ শতাংশ, কিশোরগঞ্জের ২৮ শতাংশ, নেত্রকোনার ২৭ শতাংশ, মৌলভীবাজারের ১৮ শতাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৬ শতাংশও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালের অভিজ্ঞতার চেয়ে চলমান বন্যাকে আরো ভয়াবহ বলে মনে করা হচ্ছে। সংকট এমন এক সময়ে আঘাত হানে, যখন সিলেট বিভাগের মানুষ সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে কিছুটা কাটিয়ে উঠেছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আকস্মিক বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে সাতটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনুমানিক ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার কারণে অনেক পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আবার কেউ কেউ খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। সেসব পরিবারের নারী ও মেয়েদের নিরাপত্তা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বন্যায় সিলেটের প্রায় ৪৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ হাজার মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একই সময়ে, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুনামগঞ্জের ২০০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬৫ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে নৌকার অভাবে বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্ধার করে আশ্রয়ণ কেন্দ্রে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে উদ্ধারকর্মীদের। তাছাড়া উচ্ছেদ কেন্দ্রগুলি মহিলা, মেয়ে এবং শিশুদের নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো পর্যাপ্ত নয়।

এদিকে বন্যায় ক্ষয় ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার। মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে সারাদেশে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে গরমিল।

প্রতিবেদনে বন্যায় আক্রান্ত জেলা বলা হয়েছে ১৩টি। এসব জেলার ক্ষতিগ্রস্ত স্থান, পরিবার ও লোকসংখ্যার তথ্যও দেওয়া হয়েছে। আক্রান্তের তালিকায় নাম নেই এমন জেলায়ও দেওয়া হয়েছে বরাদ্দ। আবার তালিকায় থাকা জেলাও পায়নি ত্রাণ। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সরকারি হিসাবের রয়েছে ফারাক। জেলা প্রশাসনের হিসাবের সঙ্গেও দেখা গেছে তথ্যের অমিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩ জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩১ লাখ ৪৭ হাজার ৬১২ জন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের নাম রয়েছে। এ ছাড়া শেরপুর, মৌলভীবাজার, জামালপুর, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও ফেনীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে পরিবার ও লোকসংখ্যা ছাড়া সম্পদের ক্ষতি ও মৃত্যুর সংখ্যা দেওয়া হয়নি প্রতিবেদনে। ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও রংপুরের নাম নেই। অথচ এ তিন জেলায় সাত হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় নাম থাকলেও বরাদ্দ পায়নি সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, লালমনিরহাট, ফেনী ও বগুড়া জেলা। ১৩ জেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩১ লাখ ৪৭ হাজার ৬১২ বলা হলেও শুধু সিলেট অঞ্চলেই ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছিল।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, বন্যায় অন্তত ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেখা গেছে, সিলেটে ক্ষতি গ্রস্তের সংখ্যা ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৮৪ আর সুনামগঞ্জে ৫ লাখ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে জানানো হয়েছে, দেশের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ডায়রিয়া, সাপের কামড়, পানিতে ডুবে, ভূমিধস এবং নানা আঘাতজনিত কারণে এ পর্যন্ত অন্তত ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে ১৮ ও ময়মনসিংহ বিভাগে মারা গেছে ১৫ জন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় বলছে, বন্যায় সিলেট বিভাগে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই।

পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ক্ষতিগ্রস্তের সরকারি তালিকা তড়িঘড়ি করে কেন করা হলো বুঝলাম না। সুনামগঞ্জেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ। পুরো সিলেট বিভাগে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সরকারি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন করা হলে অনেক মানুষ সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

শিক্ষক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নইম গওহর ওয়ারা বলেন, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করতে হবে সরকারের সংশ্নিষ্ট সব বিভাগের তথ্যের ভিত্তিতে। একেক সংস্থা একেক রকম তথ্য দিলে জটিলতা তৈরি হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ত্রাণ) শেখ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তা চূড়ান্ত নয়। জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আসা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। অনেক জেলা এখনও পানির নিচে, ফলে তথ্য আসতে দেরি হচ্ছে। তথ্যে কোনো ভুল থাকলে সেটি সংশোধন করা হবে।

এদিকে ইউনিসেফ জানায়, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৬ লাখ শিশুসহ ৪০ লাখ মানুষের জরুরি ভিত্তিতে সহায়তার প্রয়োজন। শিশুদের সুরক্ষা এবং জরুরি পানি ও স্বাস্থ্য উপকরণ প্রদানে ইউনিসেফ মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। ইউনিসেফ আরো জানায়, বন্যায় ৩৬ হাজারের বেশি শিশু-কিশোর তাদের পরিবারের সঙ্গে জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে, যা তাদের পড়াশোনাকে আরও বিঘ্নিত করছে।

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, আটকে পড়া লাখ লাখ মানুষের জন্য সমবেদনা জানাচ্ছি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শিশুরাই সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে আছে। শিশুদের জরুরি প্রয়োজনগুলো মেটাতে ইউনিসেফ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং অংশীদারদের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিশু ও পরিবারগুলোকে জীবনরক্ষাকারী উপকরণ ও সেবা প্রদানে ২৫ লাখ ডলারের আহ্বান জানাচ্ছে ইউনিসেফ।

শেলডন ইয়েট আরো বলেন, শিশুদের এই মুহূর্তে নিরাপদ খাবার পানি প্রয়োজন। পানিবাহিত মারাত্মক রোগ গুরুতর সমস্যাগুলোর অন্যতম। ইউনিসেফ ইতোমধ্যেই ৪ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠিয়েছে, যা দিয়ে ৮০ হাজার পরিবারের এক সপ্তাহ চলবে। লাখ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ১০ হাজারের বেশি পানির পাত্র এবং নারী ও কিশোরীদের জন্য হাজার হাজার স্বাস্থ্য উপকরণ বিতরণসহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের জরুরি কার্যক্রমে আরও সহায়তা প্রদানেও ইউনিসেফ কাজ করছে। জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর জন্য জরুরি ওষুধও কিনছে ইউনিসেফ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads