• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশ

ছবি: সংগৃহীত

পর্যবেক্ষণ

কালবৈশাখীর মেঘ কেন কালো?

  • তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ০৩ মে ২০১৮

৩০ এপ্রিল। সকালেই ঝড়-বৃষ্টির আভাস দেয় উত্তর আকাশে জমতে থাকা খণ্ড খণ্ড মেঘ। বেলা একটু বাড়তে থাকলে আকাশে রোদের শেষ রেখাটুকুও মিলিয়ে যায়। ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় ঢাকার আকাশ। সাড়ে ১১টার দিকে চারদিকে নেমে আসতে শুরু করে রাতের আঁধার। ১০ মিনিটেই আঁধারে ঢেকে যায় সারা ঢাকা।

গতকাল ২ মে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ঠিক একই ঘটনা ঘটে। কালো পর্দার মতো ঘনকালো মেঘের স্তরে ঢাকা পড়ে ঢাকার আকাশ। বাসা-বাড়িতে জ্বলে ওঠে বাতি। সড়কে বাধ্য হয়ে মোটরযানগুলো জ্বালায় আলো।

কিছুদিন আগে গত ৩০ মার্চও ঢাকার আকাশ ঢেকে যায় ঘন কালো মেঘে। ওইদিনও ঝলমলে তপ্ত দুপুরের পরে বিকাল নামতেই বদলে যায় ঢাকার আকাশ। কালো মেঘে দিনের আলো উবে গিয়ে সন্ধ্যার আগেই নেমে আসে সন্ধ্যা। এমন পরিস্থিতিতে নগরবাসীর মন দুরু দুরু করেই। মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, কী জানি কী হয়! তবে সব কয়দিনই বড় কোনো ক্ষতি ছাড়াই কালবৈশাখীর মেঘ ঝরে গেছে বৃষ্টি হয়ে।

কিন্তু এমন ঘন কালো মেঘ করে হুট হাট নেমে আসা রাতের আঁধার কিছুটা উৎকণ্ঠায় ফেলে নগরবাসীকে। তবে যদি জানা থাকে কেন বৈশাখ মাসের মেঘ এমন ঘন কালো হয় তবে হয়তো প্রাথমিক উদ্বেগ আর শঙ্কার পারদ নিচের দিকেই থাকবে।

কালবৈশাখী কী

কালবৈশাখী এক ধরনের বজ্রঝড় যা সচরাচর এপ্রিল-মে (বৈশাখ) মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কালবৈশাখী অর্থ কালো বর্ণের বৈশাখী মেঘ। ঘন, কালো বর্ণের মেঘ ও ঝঞ্ঝা এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির জন্যই এ নামকরণ। স্থানীয়ভাবে কোনো এলাকার ভূ-পৃষ্ঠ অত্যধিক তাপমাত্রা অথবা অন্যান্য কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বায়ুমণ্ডল যথেষ্ট অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং এ ঝড়ের জন্ম হয়। উত্তপ্ত, হাল্কা ও অস্থির বায়ু ঊর্ধ্বমুখী উঠতে থাকে এবং সমতাপীয় সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় বায়ুস্তর সম্পৃক্ত বিন্দুতে না পৌঁছা পর্যন্ত শীতল হতে থাকে এবং কিউমুলাস মেঘ সৃষ্টি হয়। বায়ুমণ্ডলের অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে কিউমুলাস মেঘ উলম্বভাবে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ গঠন করে এবং পরবর্তী সময়ে বজ্রঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয় যা সকালবৈশাখী নামে পরিচিত।

কিন্তু কেন এই মেঘ এত কালো হয়?

সব মেঘে বৃষ্টি নামে না- কথাটি প্রবাদ হয়ে গেছে। শরতের শুভ্র সাদা মেঘমালায় আকাশ ছেয়ে থাকলেও তাতে বৃষ্টি নামে না। আবার আষাঢ় বা শ্রাবণ মাসে সাধারণত সারা আকাশজুড়েই থাকে ধূসর রঙের মেঘ। ওই মেঘই নামায় বিরামহীন বৃষ্টি। কিন্তু বৈশাখ মাসের মেঘ কেন কালো হয়? কেন ভরদুপুরে নেমে আসে রাতের আঁধার?

বিজ্ঞানীরা এর পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

সূর্যালোক

বৈশাখ মাসের মেঘ সাধারণত পুরু ও ভারী হয়। এ কারণে ওই ভারী মেঘের স্তর ভেদ করে ভূপৃষ্ঠের দিকে সূর্যের আলো আসতে পারে না ফলে মেঘগুলো কালো দেখায়। গবেষকদের মতে, এ ধরনের মেঘের পুরুত্ব ৩০০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে যা সূর্যালোকের পক্ষে ভেদ করা প্রায় অসম্ভব। আর এ সময় ভূপৃষ্ঠে অবস্থান করা আমাদের চোখ আর মেঘের মধ্যে এমন একটা ঘন কালো পর্দা তৈরি হয়। নেমে আসা অন্ধকার আমাদের দর্শনসীমার দিগন্ত রেখা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ফলে চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়।

জলকণা

কিউমুলাস বা ঘনীপুঞ্জীভবন পর্যায়, পূর্ণতা পর্যায় এবং ৩ বিচ্ছুরণ পর্যায়- এই ধাপে ঘটে থাকে। একটি কালবৈশাখী পূর্ণতা লাভের ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর এর তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে এবং বিচ্ছুরণ পর্যায়ে প্রবেশ করে। এরপর অতি দ্রুত হারে মেঘের তাপমাত্রা হ্রাস, মেঘে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতি বাড়ে। একই সঙ্গে বায়ুর পুঞ্জীভূত ঊর্ধ্বচলনের কারণে শিলাকণাও জমে মেঘে।

বরফ কণা ও জলকণার আকারের কারণে সেগুলো সূর্যের আলো বিকিরণ ও প্রতিফলন একই সঙ্গে ঘটায়। কিন্তু সেটি বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার আগে বিচ্ছুরিত আলোর বিভিন্ন বর্ণ আমাদের চোখে আর ধরা পড়ে না। ফলে আমরা সে সময় মেঘকে কালো দেখি।

মেঘের ছায়া

বৈশাখ মাসে সাধারণত কয়েক স্তরের মেঘ হয় আকাশে। এ সময় এক স্তরের মেঘের ওপর আরেক স্তরের মেঘের ছায়া পড়লে ছায়াযুক্ত মেঘকে কালো দেখানোই স্বাভাবিক। বিভিন্ন মেঘখণ্ড আকাশে সূর্যালোক ও ভূপৃষ্ঠের দর্শকের চোখের সঙ্গে বিভিন্ন কোণ তৈরি করে। আর এর কারণে এক স্তরেই একাধিক মেঘের ছায়া পড়তে পারে। আর এ কারণে মেঘ কালো দেখায়। এই ঘটনাটা সাধারণত বিকালেই বেশি ঘটে। আর আমরা দেখি দিন শেষ হওয়ার আগেই নিভে যায় দিনের আলো।

ভারী মেঘমালা

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে সারা দেশে বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে দৈনিক তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে এই সময় দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আসা উষ্ণ ও আদ্র বায়ু যা ঊর্ধ্বে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত আরোহন করে থাকে এবং এ উষ্ণ ও আদ্র বায়ু উত্তর-পশ্চিম এবং পশ্চিম দিক থেকে আসা অপেক্ষাকৃত শীতল ও শুষ্ক বায়ুর সঙ্গে মিলিত বা মুখোমুখি হয়। বায়ুমণ্ডলের এই অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে কিউমুলাস মেঘ উল্লম্বভাবে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ গঠন করে।

এই কিউমুলোনিম্বাস মেঘ ৪৫ হাজার ফুট পর্যন্ত ওপরে উঠে যায়। আর এই দূরত্বের কারণে মেঘের রঙ ধূসর হলেও দূরত্বের কারণে তা কালো দেখায়।

এই কারণগুলো ছাড়াও বৈশাখ মাসে মেঘ কালো হওয়ার আরেকটি কারণ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। বলা হয়, এই সময়টা শুষ্ক বলে বাতাসে ধূলিকণার সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। ফলে আকাশের দিকে আমাদের দৃষ্টিসীমা কমে আসে অনেকটা। আবার এইসব ধূলিকণার কিছু মেশে মেঘের সঙ্গেও। আর সেইসব ধূলিকণা জলের সঙ্গে মিশে ধূসর থেকে হয়ে যায় কালো। আর এ কারণেই বৈশাখ মাসে মেঘ কালো হয়, কখনো কখনো ভরদুপুরে নেমে আসে রাতের আঁধার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads