• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ছবি : সংগৃহীত

ধর্ম

গল্পে গল্পে ইতিহাস

বাংলা সন এসেছে হিজরি সন থেকে

  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০১৮

এই ভরদুপুরেও সূর্যের দেখা নেই। কালো হয়ে আসছে চারদিক। বাতাস ক্রমে প্রবল হচ্ছে। মেঘের গর্জনও ভয়ঙ্কর হচ্ছে ক্রমশ। ঝড়তুফানের পূর্বাভাস; লোকজনও গন্তব্যে ছুটছে...

বাঙালি মানেই সংগ্রাম, সঙ্কট আর লড়াইয়ের জীবন। বছরের শুরু থেকেই প্রকৃতি তার সন্তানদের সাহসী ও সহিষ্ণু হয়ে গড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কালবৈশাখী ঝড় মনোবল শক্ত করে। বহু ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে বাঙালি। আমি হাঁটছি আর এসব কথা ভাবছি। হঠাৎ ঝুম করে আরম্ভ হলো বৃষ্টি। দৌড়ে উঠি পাশের দোকানে। আমার মতো অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে এখানে। সায়ীদ, অনন্তকেও দেখা গেল। ওরাও দেখেছে আমাকে। হাত বাড়িয়ে ডাকছে- ‘দাদা, এখানটায় এসে বসুন।’

আমি গেলাম। ওদের মাঝখানটায় গিয়ে বসলাম। শুনলাম ওরা কথাবার্তা বলছে বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে। অনন্ত বলছে, ‘কখনই না; বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন অমুক। তিনিই এর প্রবর্তক।’ সায়ীদ ওকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে, হিজরি সন থেকেই বাংলা সনের উৎপত্তি। কিন্তু কীভাবে হয়েছে উৎপত্তিটা, তা পরিষ্কার বোঝাতে পারছে না।

পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখে আমি বলি, অত তর্কাতর্কির দরকার নেই; পণ্ডিতরাই সেরে ফেলেছেন এ কাজটা। এই বলে মুচকি একটি হাসি দিলাম। ওরাও নড়েচড়ে বসল। বললাম, চল কীভাবে উদ্ভব ঘটল বাংলা সনের, হালকা ঘাঁটাঘাঁটি করি ইতিহাস থেকে।

-‘আপনার জানা আছে দাদা?’ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে সায়ীদ। আমি বলি, ‘আজকেও স্টাডি করেছি বিষয়টি।’

-‘ওকে, তাহলে আমাদেরও একটু শোনান দাদা!’ সায়ীদ-অনন্ত দুজন একত্রে আবদার করল।

আমি তখন বলা শুরু করলাম, ‘বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে দুটো মত রয়েছে। কারো মতে প্রাচীন বঙ্গ দেশের রাজা শশাঙ্ক চালু করেন বাংলা সন। তিনি আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বইতে লিখেছেন, ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ সোমবার) বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়েছিল এবং ওই দিনই শশাঙ্ক গৌড়বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেছিলেন। কিন্তু এ মতটি ধোপে টেকে না। অকাট্য কোনো প্রমাণও নেই এই মতের পক্ষে। তবে দ্বিতীয় মতটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত।’

-‘সেটি কী দাদা? বিস্তারিত বলুন!’ অনন্ত উৎসুক হয়ে তাগাদা দেয়। সায়ীদকেও কৌতূহলী দেখাচ্ছে। তাই আমি আবার বলতে শুরু করি- ‘বাংলাদেশে বর্ষপঞ্জি ও দিনপঞ্জির ক্ষেত্রে সন, সাল, তারিখ- শব্দ তিনটি নিত্য ব্যবহূত হয়। এই সন শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আর সাল শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে এবং তারিখ শব্দটিও কিন্তু আরবি।’

আমার কথা শুনে অনন্ত-সায়ীদ একে অপরের দিকে তাকায়। ভাবখানা এমন, হ্যাঁ তাই তো! আমি আমার কথা সামনে আগাই- বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি সন প্রচলিত- বাংলা, হিজরি ও ইংরেজি। এর মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি সন দুটি সৌর বর্ষ। আর হিজরি সনটি চান্দ্র বর্ষ। সূর্যের পরিক্রমার হিসেবে যে সন গণনা করা হয় সেই সনকে বলা হয় সৌর সন বা সৌর বর্ষ। আর চাঁদের পরিক্রমার হিসেবে যে সন গণনা করা হয় তাকে বলা হয় চান্দ্র বর্ষ বা চান্দ্র সন। মুঘল বাদশাহ আকবরের সময়কার কথা। ভারতের হিন্দুরা তখন সৌর বছর অনুযায়ী তাদের দিন গণনা করত। অপরদিকে মুসলিম মুঘল শাসকরা অভ্যস্ত ছিলেন আরবি চন্দ্র বছর অনুযায়ী দিন গণনা করে। ফলে স্থানীয় কৃষকদের চাষাবাদের সময় আর বাদশাহের রাজস্ব আদায়ের দিনক্ষণে সৃষ্টি হয় বিরাট সমস্যা। বাদশাহ আকবর চিন্তিত হয়ে পড়েন। তলব করলেন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেহুল্লাহ সিরাজীকে। তিনি উপস্থিত হলে এই সমস্যার সমাধান বের করতে বাদশাহ নির্দেশ দেন। সিরাজি তখন শুরু করেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অবশেষে হিজরি বর্ষকে সামনে রেখে বর্ষ গণনা করে ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি নতুন সন উদ্ভাবন করেন তিনি। পরে সেটি বাদশাহর দরবারে পেশ করেন। বাদশাহ আকবর তাতে অনুমোদন দান করেন এবং এই সন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের ফরমান জারি করেন। এভাবেই শুরু হয় নতুন বাংলা সনের আবিষ্কার ও সূচনা। 

এর পরের কথাগুলো আমরা বিস্তারিত জানব অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূমের প্রবন্ধ থেকে। এই বলে আমি পকেট থেকে পত্রিকার একটি কার্টিং বের করি এবং পড়তে থাকি, ‘বাংলা সনের উৎপত্তি ইসলামী উৎস থেকে। এ যে হিজরি সনেরই সৌররূপ এবং মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে আমীর ফতেহুল্লাহ সিরাজী কর্তৃক হিজরি সনকে সৌর গণনায় এনে একটি নতুন সনে পরিণত করা হয়, সে সম্পর্কে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে গঠিত বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপসংঘের সুপারিশমালার প্রারম্ভে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এই কমিটির সুপারিশমালার প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছে, মুঘল আমলে বাদশা আকবরের সময় হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে যে বঙ্গাব্দ প্রচলন করা হয়েছিল তা থেকে বছর গণনা করতে হবে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত উক্ত কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকার কিছু কিছু সংস্কার করা হয়।

বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকে সংস্কারকৃত বাংলা সন আশির দশকে এসে সরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে। বাংলা সনের উদ্ভাবক আমীর ফতেহুল্লাহ সিরাজী আর এর সংস্কারক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা সন বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব সন। এর উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস ইসলামী উত্তরাধিকার সঞ্জাত।’ (দৈনিক ইনকিলাব। ১৪ এপ্রিল ২০১৭)

লেখাটা পড়ে শেষ হওয়ার পর আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি এবং দেখি দুজনই অনেকটা তৃপ্তি জড়ানো চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখে চোখ পড়তে প্রায় একই সময় দুজনই বলে উঠল- ‘দাদা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। সত্য ইতিহাসটা জানলাম। সার্থক আমাদের এবারের পহেলা বৈশাখ।’

 

আবদুল্লাহ মারুফ

লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads