• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি : ফাইল ছবি

ধর্ম

প্রকাশনা শিল্পে আলেমসমাজ

দিন দিনই বাড়ছে ইসলামী প্রকাশনার জনপ্রিয়তা

  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০১৮

বাংলাদেশের আলেমসমাজ বিভিন্নভাবেই ইসলামের প্রচার-প্রসারে দায়িত্ব পালন করে আসছে। বাংলাদেশের আলেমসমাজ দ্বীনের প্রচারে বড় একটি দেখমত করছেন ইসলামী প্রকাশনার মাধ্যমে। ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে কুরআন-হাদিসে আলোকে প্রয়োজনীয় বই প্রকাশ করে মানুষের কাছে ইসলামের সঠিক বার্তা তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তারা যেমন দেখছেন সম্ভাবনা ঠিক তেমনি সম্মুখীনও হচ্ছেন কিছু সমস্যারও। দশজন ইসলামী প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ

 

১. মুহাম্মদ মোস্তফা, স্বত্বাধিকারী, ইসলামিয়া কুতুবখানা

তিনি বলেন, ‘আমি যখন বই নিয়ে কাজ শুরু করেছি তখন প্রকাশনার সংখ্যা খুব কম ছিল। ইসলামী প্রকাশনার সার্বিক মানও নিম্নমানের ছিল। বিষয়টি আমার খুব খারাপ লাগত। আমি ভাবতাম, বাংলাভাষায় ইসলামের বড় খেদমত হওয়া প্রয়োজন এবং ইসলামী বইয়ের ভাষাসহ সার্বিক মানোন্নায়ন হওয়া প্রয়োজন। সেই চিন্তা থেকেই আমি ইসলামী প্রকাশনার জগতে কাজ শুরু করি। আমাদের প্রকাশনীতে বিভিন্ন প্রকারের বই আছে। কিছু প্রকাশনা আছে বছরের সব সময় যাদের বই বিক্রি থাকে না। কিন্তু আমাদের কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। তবে ইসলামী প্রকাশনার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা খুব ভালো। মানুষ দিন দিন ইসলামী বই পড়ার দিকে ঝুঁকছে। বইয়ের মান ভালো করলে পাঠক আরো অনেক বাড়বে।’

 

২. আহমাদ গালিব, স্বত্বাধিকারী, মাকতাবাতুল ইসলাম

তিনি বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে ব্যবসা করব। ভোক্তাদের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আমি ব্যবসায় এসেছি। তুলনামূলক আমাদের ইসলামী বইয়ের বিক্রি অনেক বেশি। যারা গল্প-উপন্যাসের বই পড়েন তারা শুধু এই বইগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন না। তারা বিভিন্ন বিষয় জানার জন্য ইসলামী বইও পড়েন। আবার যারা এমন আছেন যে, কোনো বই-ই পড়েন না, তারাও কোরআন-হাদিসের বই অর্থাৎ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ে থাকেন। সুতরাং ইসলামী বইয়ের বিক্রি অনেক বেশি। ইসলামী প্রকাশনার সম্ভাবনাই বেশি। সরকার ও বিভিন্ন অর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেলে ইসলামী প্রকাশনা শিল্প আরো উন্নত ও সফল হবে। আশা করব, সরকার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এদিকে দৃষ্টি দেবেন।’

 

৩. মাহমুদুল ইসলাম, স্বত্বাধিকারী, রাহনুমা প্রকাশনী

তিনি বলেন, ‘একজন প্রিয় শিক্ষকের বই প্রকাশের মাধ্যমে প্রথমে শখে পরে আস্তে আস্তে এই পেশাতে নিয়মিত হয়েছি। ইসলামী প্রকাশনার মানোন্নত করার চেষ্টায় অনেকটা সফলও হয়েছি। ইসলামী প্রকাশনীর ভবিষ্যত সম্ভাবনা খুবই ভালো। ইসলামী বইয়ের চাহিদাও অনেক বেশি আর এ কারণেই এই ক্ষেত্রে ভালো লেখকদের সঙ্গে এমন অনেক লেখক ঢুকে পড়ছে যারা বইয়ের পাণ্ডুলিপি সামান্য পরিবর্তন করে একাধিক প্রকাশকের কাছে বিক্রি করে। এ বিষয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতনতা জরুরি। ইদানিং অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের লেখকদের বই অনুবাদ করছেন এ ক্ষেত্রেও সাবধানতা জরুরি। বাংলাবাজার কেন্দ্রিক ‘পুস্তকপ্রকাশক সমিতি’ থাকলেও ইসলামী বই প্রকশনার মর্যাদাশীল ভবিষ্যৎতের দিকে তাকিয়ে একটি ‘ইসলামী পুস্তক সমিতি’ এখন সময়ের দাবি। আশা করব দায়িত্বশীলরা এই বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেবেন।’

 

৪. শাকের হোসেন শিবলী, স্বত্বাধিকারী, মাহফিল প্রকাশনী

তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) এবং সাহাবিরা (রা.) আমাদের সব ক্ষেত্রেই আদর্শ। নবী (সা.) সব পেশাতেই কাজ করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই আমার ইচ্ছা ছিলো যে, লেখাপড়া শেষ করে আমি ভিন্ন কিছু করব। ভিন্ন কিছু করার সেই ইচ্ছা থেকেই আমার প্রকাশনার পথে আসা। ইসলামী প্রকাশনার বইয়ের মান আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। তবে এই মান আরো ভালো করতে হবে। এই কাজটা কোনো একজন প্রকাশকের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামী প্রকাশনা ব্যবসার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সঙ্কট একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা অনেক। ইসলামী ব্যাংকগুলো যদি ইসলামী প্রকাশনায় ইনভেস্টে এগিয়ে আসে তাহলে এই ব্যবসা সেক্টরটি আরো উন্নত হবে।’

 

৫. আবু সাঈদ মুহাম্মাদ হাবিবুল্লাহ, স্বত্বাধিকার, শর্ষিণা প্রকাশনী

তিনি বলেন, ‘মাদরাসায় পড়ে পড়ানো যেমন একটি দ্বীনি খেদমত ঠিক ইসলামী বই বিক্রি করাও দ্বীনের খেদমত। মাদরাসায় পড়ানোকে আমি কখনো ছোট করে দেখি না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় বই বিক্রি করা তার থেকে বড় দ্বীনি খেদমত। কেননা ইসলামী বই সবারই প্রয়োজন হয় এবং কম-বেশি সবাই পড়ে। তাই আমার মনে হয়েছে ইসলামী বই মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমেই আমি বেশি মানুষের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছে দিতে পারছি। এ জন্যই আমি ইসলামী প্রকাশনায় এসেছি। একটা সময় ইসলামী বইয়ের মান খুব একটা ভালো ছিল না। এখন ইসলামী বইয়ের মান অনেক ভালো। এখন ইসলামী বইয়ের একটি স্বর্ণযুগ চলছে। আশা করছি এই স্বর্ণযুগ আর কমবে না বরং আরো বাড়বে।’

 

৬. আমিনুল ইসলাম, স্বত্বাধিকারী, বইঘর প্রকাশনী

তিনি বলেন, ‘ইলম শিক্ষা করার পর কর্তব্য হলো ইলমকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। কেউ এই ইলেমের প্রচার-প্রসার করে থাকেন শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে। আবার কেউ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে। আমি আলেম হয়ে প্রকাশনার জগতে ব্যবসা করতে আসিনি। আমি এসেছি সবার মাঝে ইসলামী জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে। সামগ্রিক প্রকাশনার জগতেই বেশ কিছু সমস্যা আছে সেই ক্ষেত্রে ইসলামী প্রকাশনার ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরো একটু বেশি। বর্তমানে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত সকল উপকরণের মূল্য অনেক বেশি। বিভিন্ন সময় হঠাৎ করে কালি অথবা কাগজের মূল্য বেড়ে যায়। সুতরাং এই বিষয়গুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দৃষ্টি দিলে ইসলামী প্রকাশনা শিল্প আরো অনেক ভালো করবে এবং অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’ 

 

৭. মুহাম্মাদ আদম আলী, স্বত্বাধিকারী, মাকতাবাতুল ফুরকান

তিনি বলেন, ‘ইসলামী প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে কাজ করারও অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। তবে একটি বিষয় হচ্ছে মানুষ ইসলামকে সস্তা জিনিস মনে করে। আর এ কারণে কেউ ইসলামী বই দাম দিয়ে কিনতে চায় না। মনে করে ইসলামী বই কেন এত মূল্য দিয়ে কিনতে হবে। মূলত ইসলামী বই-ই বেশি মূল্য দিয়ে ক্রয় করা প্রয়োজন। তবে এখন এমন কিছু পাঠক তৈরি হয়েছে যারা ভালো বই পড়তে চায়। মূল্য দিয়ে ইসলামী বই ক্রয় করতে চায়। তার থেকে বড় কথা হচ্ছে মানুষ এখন ইসলামকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। আগের তুলনায় মানুষ এখন অনেক বেশি ধার্মিক। আমরা চেষ্টা করছি মানুষের কাছে ধর্মের সঠিক বিষয়গুলো পৌঁছে দিতে।’

 

৮. মানযূর হাসান যুবায়ের, স্বত্বাধিকারী, গ্রন্থালয়

তিনি বলেন, ‘আলেম হয়ে আমি প্রকাশনা ব্যবসায় এসেছি মূলত ইলমের খেদমত করতে। বাকি এ্রখন যদি ব্যবসা হয়ে যায়, লাভ হয়ে যায় তা হবে বাড়তি পাওনা। আর একটি কারণ হলো প্রকাশনা জগতে নতুন কিছু করার স্বপ্ন এবং প্রকাশনা জগতের কিছু অবহেলিত দিক আছে সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু করা যায় কিনা সে প্রচেষ্টা করা। ইসলামী প্রকাশনা জগতে এখন প্রধান সমস্যা হলো যাচাই-বাছাই না করে বই প্রকাশ করা। অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে অনুবাদ যাচাই না করা। এই সমস্যার ক্ষেত্রে দায় যেমন লেখকের আছে, দায় আছে প্রকাশকেরও। প্রত্যেক প্রকাশনীতে যাচাই-বাছাই ও সম্পাদনা পরিষদ থাকা জরুরি। লেখক-প্রকাশক-পাঠকের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বলে দিচ্ছে ইসলামী প্রকাশনা জগতের ভবিষ্যৎ আশা জাগানিয়া।’

 

৯. শাহাদাত বিন শামসুজ্জামান ভূঁইয়া, স্বত্বাধিকারী, মাকতাবাতুত তাকওয়ার

তিনি বলেন, ‘মাদরাসায় পড়ানো যেমন খেদমত বইয়ের মাধ্যমে মানুষের কাছে জ্ঞান পৌঁছানোও তেমনই খেদমত। তাছাড়া মাদরাসায় পড়ালে আমি যে কয়জনকে পড়াতে পারতাম তার থেকে অনেক বেশি মানুষের কাছে এই খেদমতের মাধ্যমে দ্বীন পৌঁছাতে পারছি। তাই আমি এই পথকে খেদমতের জন্য নির্ধারণ করেছি। আমাদের লক্ষ্য হলো মানুষের কাছে শুদ্ধ ও বিশুদ্ধ কোরআন সুন্নাহ পৌঁছে দেওয়া। যাতে মানুষ বিদআত মুক্ত সঠিক ইবাদত করতে পারে। সাধারণ প্রকাশনাগুলি থেকে ইসলামী প্রকাশনার অবস্থা অনেক ভালো। একটা সময় ইসলামী প্রকাশনাগুলোর অবস্থা ভালো ছিল না এখন দিন দিন ভালো হচ্ছে। আর এ কারণেই অনেক তরুণ প্রকাশনা ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে আরো ভালো হবে।’

 

১০. মুহাম্মাদ দেলাওয়ার হুসাঈন, স্বত্বাধিকারী, হুদহুদ প্রকাশনী

তিনি বলেন, ‘আমি যখন মাদরাসাতে পড়তাম তখন থেকেই ভাবতাম আমি বড় হয়ে ব্যবসায়ী হব। এ কারণে আমি ছোট থেকেই খোঁজ-খবর রাখতাম আসলে প্রকাশনা ব্যবসা করার জন্য কী কী প্রয়োজন হয়? পড়াশুনা শেষ করার পর একটি প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করেছি এবং সেখান থেকে বিস্তারিত বিষয়গুলো শিখেছি। এর পরই মূলত আমি এই প্রকাশনা দিয়েছি। ইসলামী প্রকাশনায় অনেক সম্ভাবনা আছে এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবায়ন হবে যদি সরকার এগিয়ে আসে। আমাদের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের বইয়ের বিজ্ঞাপণ পত্রিকাগুলোতে যায় না। যারা গল্প-উপন্যাসের বই লেখে তাদের একটি ছোট বইয়েরও বিজ্ঞাপণ পত্রিকায় যায়। আমরা যদি বিভিন্ন বইয়ের বিজ্ঞাপণ পত্রিকাগুলোতে দিতে পারি তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads