• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

অপরূপ নেয়ামতধন্য বসন্তকাল

  • প্রকাশিত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মোস্তফা কামাল গাজী

 

 

 

পাতাঝরা বসন্ত ছুঁয়েছে বাংলার নৈসর্গকে। ফুলের মহীরুহ সেজেছে নানা রঙে। গাছের শাখে পাখিরা মেতেছে নতুন কোলাহলে। মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ায় বর্ণবিরল প্রকৃতির অঙে লেগেছে পুলকসঞ্চার। বনবীথিকার রিক্ত শাখে জেগেছে নতুন কুঁড়ির উল্লাস। শহুরে জীবনে বসন্তের তেমন ছোঁয়া না লাগলেও গ্রাম্যজীবনে বাস্তবিক পক্ষেই বসন্ত নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দ আর নির্মল সুখের বার্তা। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেয় সৌন্দর্যের সব শাখা-প্রশাখা। শোভা-সৌন্দর্যের রেশ ধরে শীতের চাদর সরিয়ে ঘন গৌরবে নবযৌবনে আসে বসন্ত। থোকায় থোকায় কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া জানান দেয়, বসন্ত এসে জুড়ে গেছে প্রকৃতির প্রতিটি কোণে কোণে। লতাপাতার ফাঁকে ফাঁকে একসঙ্গে বেজে উঠে হাজারো পাখির সুর। পলাশ-শিমুলের শাখে শাখে ফাগুনের আগুন লেগে যেন দাউদাউ করে। শীতের পাতাঝরা গাছ আর বিষণ্ন প্রকৃতিতে শুরু হয় নবপ্রাণের সঞ্চার। সর্বত্র খুশির একটা আমেজ ফুটে ওঠে। কেবল মানুষ নয়, প্রতিটি প্রাণীর মনে বসন্ত আনন্দের দোলা দেয়। নতুন নতুন প্রাণের বিকাশ ও প্রকাশ জানান দেয়, বসন্ত সর্বজনীন, সবপ্রাণের। ক্ষণে ক্ষণে কোকিলের কুহু কুহু তান আনন্দের বাঁশি বাজিয়ে যায় মনমহুয়ায়। পলাশ, শিমুলের শাখে শাখে ফাগুনের আগুন লেগে যেন দাউ দাউ করে। চন্দ্রমল্লিকা, মহুয়া, বকুল, সুরভি রঙ্গন, পুলক জুঁই, গন্ধরাজ, শ্বেত শিমুল, কুর্চি ফুলের গাছেও লাগে বসন্তের ছোঁয়া। নবপ্রাণের বিকাশ জানান দিয়ে যায় হাওয়া বদলের কথা। সময়-অসময়ে ভাবুক মন হারায় কেবল নন্দন মুগ্ধতায়। বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা ফুটে উঠেছে কবিগুরুর কবিতায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে/কত ফুল ফোটে/কত বাঁশি বাজে/কত পাখি গায়...।’

বসন্তে মোহনীয় আভা ছড়িয়ে প্রতি সকালে সূর্য ওঠে। কাঁচা সোনারোদ ছড়িয়ে পড়ে মাঠ-ঘাট, বনবাদাড় সবখানে। মৃদু হাওয়ায় কাঁপে গাছের শাখা-প্রশাখা। টুপটাপ ঝরে পড়ে শিমুল ফুল। মুহূর্তে রক্তিম হয়ে উঠে শিমুলতলা। মাতাল হাওয়ায় উদাসী বনে যায় মন। চারদিকে আহ কী শোভা-সৌন্দর্য! অপরূপ সুন্দরের বাঁধন। স্নিগ্ধ ও নিখুঁত সৃষ্টি! মনে পড়ে যায় পবিত্র কোরআনের বাণী, ‘পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে, আমি সেগুলোকে তার শোভা করেছি। মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মাঝে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত-৭)। মহান প্রভুর গড়া এত সুন্দর প্রকৃতি অবলোকন করেও অনেকে স্রষ্টাকে চিনতে পারে না। ভুলে যায় তার নিখুঁত কারিগরকে। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের সতর্ক করে বলেন, 'তারা কি নভোম্ললের প্রতি দেখে না, কীভাবে তিনি তা বানিয়েছেন, সুশোভিত করেছেন? আর নেই তাতে কোনো ছিদ্রও!' (সুরা কাফঃ ৬)

বসন্ত মানেই ফুলের সমাহার। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বসন্তের অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি। বসন্তের ছোঁয়া পেয়ে জেগে ওঠে মৃতপ্রায় প্রকৃতি। এসবই হয় আল্লাহ তাআলার কুদরতি ইশারায়। ইরশাদ হয়েছে, 'আপনি পৃথিবীকে নিষ্প্রাণ দেখতে পান। এরপর আমি যখন এর ওপর পানি বর্ষণ করি তখন তা সক্রিয় হয়ে ওঠে ও ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং প্রত্যেক প্রকার উদ্ভিদের সবুজ শ্যামল শোভাম্লিত জোড়া উৎপন্ন করে।' (সুরা হজঃ ৫)

বন-বাদাড় আর কাননে কাননে মনের সুখে উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি ও মৌমাছির ঝাঁক। মৃদু হাওয়ায় কাঁপে গাছের শাখা-প্রশাখা। টুপটাপ ঝরে পড়ে শিমুল ফুল। মুহূর্তে রক্তিম হয়ে ওঠে শিমুলতলা। মাতাল হাওয়ায় উদাসী বনে যায় মন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, 'এল এ বনান্তে পাগল বসন্ত/বনে বনে মনে মনে রঙ সে ছড়ায়রে/চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।' কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, 'হয়ত ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসংগীতে যত আছে/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁঁখি/তবুও ফুটেছে জবা, দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।'

প্রাণের বসন্তে মন চায় প্রজাপতি হয়ে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে। মৌমাছি হয়ে মধু আহরণ করতে। পাখি হয়ে মধুর সুরে গান গাইতে। কখনও মন চায় প্রকৃতির অমল সৌন্দর্যে মিশে যেতে। বসন্ত নানা রং আর ফুলের বাহার নিয়ে উপস্থিত হয় বলে তাকে ছাড়তে মন চায় না কখনও। কিন্তু বাংলার প্রকৃতিতে বসন্তের স্থায়িত্ব নেই তেমন। এখানে বসন্ত আসতে না আসতেই ফুরিয়ে যায়। ফাল্গুন শেষে চৈত্র এলেই নিদারুণ তাপপ্রবাহে চৌচির হয়ে ওঠে প্রকৃতি। তারপরও এত অল্প সময়ে বসন্ত মানুষের মনের দুয়ারে ভালোলাগার যে পরশ বুলিয়ে যায়, তা কখনো ভুলার নয়। প্রকৃতিতে এত বর্ণাঢ্য আর রাজকীয়ভাবে অন্য কোনো ঋতুর অভিষেক ঘটে না। বসন্তে আগুনঝরা কৃষ্ণচূড়ার ঔজ্জ্বল্যের কারণে কোনো কোনো দেশে বসন্ত দিয়ে শুরু হয় বছর। আমাদের দেশে বছর শুরু না হলেও সানন্দে ও নানা আয়োজনে বসন্তকে বরণ করে নেয় সবাই। বর্ণিল সাজে সজ্জিত বসন্তকে জায়গা দেয় মনের কোঠায়। প্রাণে প্রাণে বয়ে যাওয়া ফল্গুধারায় উচ্ছ্বসিত মন ও মননকে আরও প্রাণবন্ত ও বর্ণিল করে নেয়। মহান প্রভুর নিখুঁত এ সৃষ্টি দেখে দেখে প্রতিটি বান্দার উচিত তার যথাযথ শুকরিয়া আদায় করা। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 'আমার নেয়ামত পেয়ে যদি শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি নেয়ামত আরও বাড়িয়ে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে মনে রেখো, আমার শাস্তি খুবই কঠিন।' (সুরা ইবরাহিমঃ ৭)

 

লেখক: শিক্ষক, জামিয়াতু ইলিয়াস আল ইসলামিয়া, টংগী, গাজীপুর।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads