• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

ইসলামে অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কের উদারতা

  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুফতি কাজী সিকান্দার

 

 

 

আমরা পৃথিবীর সব মানুষকে বিশ্বাসের দিক থেকে চার ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত আল্লাহ এবং শেষ নবীকে মানে অর্থাৎ মুসলিম। দ্বিতীয়ত যারা আল্লাহকে মানে এবং শেষ নবী  মোহাম্মদ (সা.) কে না মেনে পূর্বের কোনো নবীকে মানে যেমন, ইহুদি, খ্রিষ্টান ইত্যাদি। তৃতীয়ত যারা আল্লাহ ও নবী কাউকে না মেনে অন্য কোনো বস্তু বা দেবতার পুজা করে যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি। চতুর্থত যারা কোনো ধর্ম মানে না। যেমন নাস্তিক। এ মৌলিক চার প্রকারের প্রত্যেক প্রকারে অনেক দল ও গোষ্ঠী রয়েছে। এখন যারা ইসলাম ধর্ম পালন করে তাদের সাথে অন্যান্য ধর্ম, মত ও পথের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে তার মৌলিক বিধানে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘তোমাদের সেই লোকদের সাথে ভালো ও সুবিচারমূলক আচরণ গ্রহণ করতে নিষেধ করছেন না, যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের ঘর থেকে তোমাদের বহিষ্কৃত করেনি। আল্লাহ তো সুবিচারকারীদের পছন্দ করেন। তিনি তোমাদের বিরত রাখছেন শুধু এ থেকে যে, তোমরা বন্ধুত্ব করবে না তাদের সাথে, যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে ও তোমাদের ঘর থেকে তোমাদের বহিষ্কৃত করেছে এবং তোমাদের বহিষ্কৃতকরণে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করেছে। এ লোকদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করবে তারাই জালিম।’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত-৮, ৯)

এখানে আল্লাহতাঅয়ালা দুটি কারণের পরিপেক্ষিতে দুটি বিধান দিয়েছেন। একটি হলো সুবিচার করা। দ্বিতীয়টি হলো বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। মুসলিম ব্যতীত অন্য সব জাতির সাথে সুবিচার করার কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, বরং সুবিচার করার প্রতি মুসলিমকে উৎসাহিত করেছেন এ বলে যে, ‘আল্লাহ তো সুবিচারকারীদের পছন্দ করেন’। এখানে এ সুবিচার ন্যায়বিচার করার ক্ষেত্রে দুটি শর্ত দিয়েছেন। তা হলো যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে ঘর থেকে বহিষ্কৃত করেনি তাদের সাথে সুবিচার করতে। অপরদিকে যারা যুদ্ধ করেছে বা করছে এবং যারা তোমাদেরকে ঘর থেকে বহিষ্কৃত করেছে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে নিষেধ করেননি শুধু জুলুমও বলেছেন। তাহলে যে অমুসলিম মুসলিমদের সাথে কোনো যুদ্ধে বা তাদেরকে অত্যাচার ও নিপীড়নের সাথে জড়িত নয় এবং যারা অত্যাচার করে যুদ্ধ করে তাদেরকে সাহায্য করে না এমন অমুসলিমদের সাথে ইসলামের সম্পর্ক হলো সুবিচার, ন্যায়বিচারের। আর যারা যুদ্ধ ও যারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করছে তাদেরকে সাহায্য করেছে তাদের সাথে বন্ধুত্বহীন সম্পর্ক। এ হুকুম সব অমুসলিমের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

পূর্বের মৌলিক সম্পর্ক বজায় রেখেও ইসলাম মুসলমানকে আহলে কিতাবদের সাথে বিশেষ সম্পর্কের হুকুম দিচ্ছেন। আহলে কিতব হলো যে সম্প্রদায়ের উপর আল্লাহতায়ালা কিতাব নাজিল করেছেন এবং নবী এসেছেন উক্ত নবীকে তারা মেনেছেন এবং কিতাব মেনেছেন। আহলে কিতাবীদের সাথে সম্পর্কের সূত্র অনেক হতে পারে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক, লেনদেন থাকার সম্পর্ক ইত্যাদি। আহলে কিতাবের সাথে মুসলিমদের সামাজিক সম্পর্ক মজবুত ও দৃঢ় করার লক্ষ্যে ইসলাম কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। যা ইসলামের উদারনীতি ও সাম্যতার উৎকর্ষতা নিরূপণ হয়। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আহলে কিতাবীদের সাথে ঝগড়া ও বিতর্ক করা থেকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আহলে কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করো না। তবে উত্তমপন্থায়, তাদের ছাড়া যারা ওদের মধ্যে জালিম। আর বল, আমরা ঈমান এনেছি সেই জিনিসের প্রতি, যা আমাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে, সে জিনিসের উপরও যা তোমাদের প্রতি নাজিল হয়েছে। আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ এক ও অভিন্ন। আর আমরা তারই অনুগত আত্মসমর্পিত।’ (সুরা আনকাবুত) এখানে আল্লাহতায়ালা যেমন হুকুম দিচ্ছেন তর্ক না করতে। তেমনিভাবে সুন্দরভাবে তর্ক করার নির্দেশও দিচ্ছেন। অর্থাৎ এমন তর্ক যেন না হয় যাতে তাদের প্রতি বিদ্বেষ ছাড়ায় এবং পূর্বেকার কিতাব ও নবীকে হেয় করা হয়। এমন বিতর্কে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থেকে সুন্দরভাবে তাদের ধর্ম এখন অচল ও তাদের ধর্ম এখন পরিবর্তিত হয়েছে যুক্তির নিরেখে বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

আহলে কিতাবীদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক দৃঢ় করার ক্ষেত্রে আরেকটি নির্দেশনা রয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, আহলে কিতাবের খাবার তোমাদের জন্য হালাল, তোমাদের খাবারও হালাল তাদের জন্য। আর সুরক্ষিত পবিত্র নারী মুসলমানদের ও তোমাদের পূর্বে কিতাব পাওয়া লোকদের তাও হালাল। (সুরা মায়েদা) আহলে কিতাবের সাথে পানাহার ও তাদের জবেহকৃত পশু হালাল করে তাদের খাবার হালাল ঠিক তেমনি তোমাদের খাবার তাদের জন্য হালাল বলে এ দুজাতির মধ্যে দূরত্বের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে একেবারে নিকটে নিয়ে এসেছেন। এর মাধ্যমে ইসলাম ও আহলে কিতাব যেন দূরত্বে না থেকে একেবারে নিকটে এসে একাত্ববাদের জয়গান গেয়ে ওঠে। তবে এসবের ক্ষেত্রে যারা জালিম তাদের থেকে দূরে অবস্থান করার নির্দেশ। যারা ইসলাম ও মুসলিম ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের থেকে অবশ্যই দূরত্ব বজায় রেখেই চলতে হবে। জালিমের সাথে তো বিতর্ক নয় শুধু যুদ্ধও হবে। এধরনের লোককে সর্বযুগে চিহ্নিত করে তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। তাদের ষড়যন্ত্র থেকে ইসলাম ও মুসলিমকে হেফাজতের ফিকির করতে হবে।

আহলে কিতাব বলতে বর্তমানে দুজাতিকে বুঝানো হয়। এক. ইহুদি দ্বিতীয়. খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। যখন ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয় তখনিই ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ধর্মবিকৃত ও পরিবর্তিত হয়েছিল। তবুও ইসলাম তাদের সাথে বিবাহসহ অন্যান্য সম্পর্ক গড়ে তোলার বিধান করেছেন। তাই আমরা দেখতে পাই যে রাসুল (সা.) ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দাওয়াত গ্রহণ করতেন এবং তাদের বাড়ি গিয়ে খানা খেতেন এবং মদিনায় যাওয়ার পর মদিনা সনদ নামে অন্যান্য গোত্র ও সম্প্রদায়ের সাথে ইহুদি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল অগ্রগণ্য। আহলে কিতাবদের মধ্যে খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলমানের সম্পর্ক আরো নিবিড় ও গভীর। তা ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের বাস্তবতায় যেমন দেখা গেছে। অপর দিকে আল্লাহও তা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ঈমানদারদের বন্ধুত্বে নিকটবর্তী পাবে সেই লোকদের, যারা বলেছেন, আমরা নাসারা (খ্রিষ্টান)। তা এজন্য যে তাদের বহু পণ্ডিত বিদ্বজ্জন রয়েছে, আর তারা অহংকার করে না।’ (সুরা মায়িদা)

এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন মুসলিমরা প্রথম হিজরত করেছে আবিসিনিয়ার দিকে তখন খ্রিষ্টান রাজা নাজ্জাসী সাহাবায়ে কেরাম (রা.)কে অনেক সহযোগিতা করেছেন। মদিনাতেও তারা সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তীতে তাদের কিছু লোক ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের শিকার বা প্ররোচনায় ইসলাম ও মুসলিমের বিপক্ষে কাজ করে। যখন তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করতে লাগলো তখনি তাদের সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। বর্তমানেও তারা ইহুদিদের ভুল প্ররোচনায় কাজ করছে।

উপরোল্লেখিত সব সম্পর্ক সব স্থানের সাথে সম্পর্ক। আর ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী আহলে কিতাবদের সাথে ইসলামের আরেকটি চুক্তি রয়েছে। তাদের সাথে ইসলামের একটি ওয়াদা রয়েছে যাকে ইসলামী পরিভাষায় জিম্মি বলা হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে ইসলামী রাজা ও অমুসলিম প্রজার সুসম্পর্ক তৈরি হবে। যেসব অমুসলিম ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করবে তাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা। নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের করতে পারার নিশ্চয়তা প্রদান করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ চুক্তি পালন করা এ ওয়াদা পরিপূর্ণ করার নাম জিম্মি বিধান। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমদের জন্য যে অধিকার ঠিক তদ্রূপ অমুসলিমদের জন্যও। দায়-দায়িত্ব উভয়ের সমান। তবে শুধু বিশ্বাস ও ধর্মের ব্যাপারে ভিন্নতা রয়েছে। এখানে ইসলামের উদারতা আরো প্রতিস্থাপিত হয় যে, তারা ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করেও তাদের ধর্ম পালন করার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে এবং তাদের সব নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ করেছে। রাসুল (সা.) জিম্মিদের ব্যাপারে উম্মতকে অনেক সতর্ক করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে লোক কোনো জিম্মিকে কষ্ট বা জ্বালা-যন্ত্রণা দিল, সে যেন আমাকে কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণা দিল। আর যে লোক আমাকে জ্বালা-যন্ত্রণা ও কষ্ট দিল সে মহান আল্লাহকে কষ্ট দিল’। যে লোক কোনো জিম্মিকে কষ্ট দিল আমি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী। আর আমি যার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী তার বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি মামলা লড়ব।’ (আবু দাউদ)

ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমগণ জাকাত দেন এটি ফরজ বিধান। ফিতরা দেন, ওশর দেন এবং সদকা দিয়ে থাকেন। এখানে কিছু ফরজ কিছু ওয়াজিব কিছু সুন্নাত। আমাদের সবার জানা রয়েছে যে, অমুসলিমদের উপর জাকাত ফরজ নয়। ঠিক তেমনিভাবে তাদের উপর ফিতরা, ওশর বা সদকাও বাধ্য-বাধকতা নেই। আর অমুসলিমগণও ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণ। তবে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক জনগণকে আর্থিক সহযোগিতা করতে হয়। তা করের মাধ্যমে, ট্যাক্সের মাধ্যমে ইত্যাদি। তাই ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমগণ দেবে জাকাত আর অমুসলিমগণ চুক্তি অনুযায়ী রাষ্ট্রকে কর বা ট্যাক্স প্রদান করবে। এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র সুন্দরভাবে পরিচালিত হবে। ইসলাম সর্বত্র শান্তি স্থাপন করতে চায়। তাই মুসলিম অমুসলিম নিয়ে একটি শান্তিময় জগত গড়ার প্রত্যয়ে ইসলাম বিভিন্ন জনের সাথে বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের সাথে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, যা ইসলামের উদারতার বহিঃপ্রকাশ।

 

লেখক : পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads