• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্য

  • প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

রাশেদ নাইব

 

 

 

মহান আল্লাহর মনোনীত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম ইসলাম। একজন স্ত্রী যেমন স্বামী ছাড়া অপরিপূর্ণ ঠিক তেমনিভাবে একজন স্বামীও স্ত্রী ছাড়া অপরিপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবেই মহান আল্লাহ এই সম্পর্কটাকে একে অপরের সহায়ক এবং পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নারীরা পুরুষের অর্ধাংশ। (আবু দাউদ, তিরমিজি)। একজন স্ত্রীর কাছে স্বামীর যেমন কিছু হক বা অধিকার রয়েছে, তেমনি একজন স্বামীর কাছেও স্ত্রীর কিছু হক বা অধিকার রয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, পুরুষগণ নারীদের প্রতি দায়িত্বশীল, যেহেতু আল্লাহ একের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং তারা তাদের সম্পদ হতে ব্যয়ও করে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৪) স্ত্রী হলেন সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানের জননী, তাই স্ত্রী সম্মানের পাত্রী। স্ত্রীর রয়েছে বহুমাত্রিক অধিকার, এবং রয়েছে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য। যদি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে এবং উভয়ের পরিবার প্রত্যেকে নিজ নিজ অধিকারের সীমানা ও কর্তব্যের পরিধি জেনে তা চর্চা করে তাহলে তাদের সাংসারিক জীবন আরো অনেক বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে।

তুমি ও তোমার স্ত্রীর মাঝে জন্মগতভাবে কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহ্পাক হাওয়া (আ.)-কে হজরত আদম (আ.)-এর বুকের বাম পাশের হাড় থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাই বলা হয় নারী পুরুষেরই অংশ। তোমার শরীরের যেকোনো স্থানে আঘাত লাগলে তুমি কষ্ট পাও। আঘাত যেন না লাগে, সে ব্যবস্থা কর। সে কারণে তোমার স্ত্রীর প্রতিও লক্ষ রাখবে, সে-ও তোমার শরীরের একটি অংশ। ইজাব কবুলের মাধ্যমে সে তোমার কাছে এসেছে, তুমি তোমার শরীরের সঙ্গে যেমন ব্যবহার কর, স্ত্রীর সঙ্গেও সেরূপ ব্যবহার কর। তুমি স্ত্রীর কাছ থেকে যেমন মহব্বতপূর্ণ মোলায়েম ও ভক্তিপূর্ণ কথা আশা কর, স্ত্রীর সঙ্গে তুমিও এমন কথা বল যেন তোমার কথা থেকে মহব্বত ও ভালোবাসা ঝরে পড়ে।

মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। আর যদি তাকে তোমার অপছন্দও হয়, তবুও তুমি যা অপছন্দ করছ হয়তো আল্লাহ তাতে সীমাহীন কল্যাণ দিয়ে দেবেন। (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৯)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো মুমিন পুরুষ মুমিন নারীর ওপর রাগান্বিত হবে না। কেননা যদি তার কোনো কাজ খারাপ মনে হয়, তাহলে তার এমন গুণও থাকবে, যার জন্য সে তার ওপর সন্তুষ্ট হতে পারবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪৬৯)। অন্য এক হাদিসে এসেছে, তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ভালো মানুষ তারাই, যারা তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১১৬২)। অন্যত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, তুমি যখন খাবে, তাকেও খাওয়াবে এবং তুমি যখন পরিধান করবে, তাকেও পরাবে। তার চেহারায় কখনো প্রহার করবে না। তার সঙ্গে অসদাচরণ করবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৪২, মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৮৫০১)।

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য : সুখকর দাম্পত্য জীবন, সুশৃঙ্খল পরিবার, পরার্থপরতায় ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অটুট রাখার স্বার্থে ইসলাম জীবনসঙ্গী স্বামীর ওপর কিছু অধিকার আরোপ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এখানে প্রদত্ত হলো। ১. দেনমোহর দেওয়া। স্বামীর জন্য স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করা ফরজ। এর প্রাপ্য স্ত্রী নিজে। তার পিতা-মাতা কিংবা অন্য কারো জন্য এই হক নয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেন, তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে স্ত্রীদের মোহরানা দিয়ে দাও। (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪)। ২. বাসস্থানের ব্যবস্থা করা : নিরাপদ বাসস্থান বা নিরাপদ আবাসন। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীকে থাকার জন্য এমন একটি ঘর বা কক্ষ দেবেন, যে ঘর বা কক্ষে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া (স্বামী ব্যতীত) কেউই প্রবেশ করতে না পারে। এমনকি স্বামীর মা-বাবা, ভাই-বোনও না। স্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে এই ঘরে বা কক্ষে তিনি তালাচাবিও ব্যবহার করতে পারেন। স্ত্রীর ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বিষয়ে স্বামী ছাড়া কেউ নাক গলাতে পারবেন না। স্ত্রীর ট্রাঙ্ক ও আলমারি স্বামী ছাড়া কেউ দেখতে পারবেন না। স্ত্রীর চলাফেরা বা আচার-আচরণ শ্বশুর-শাশুড়ির অপছন্দ হলে তাকে আলাদা বাড়ি বা ঘর করে দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে স্ত্রীর ব্যবহূত কাপড়চোপড় ধুয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও স্বামীকেই করতে হবে এবং স্ত্রীর ফুটফরমায়েশ ধরার জন্য একজন কাজের লোকও রাখবেন স্বামী (কিতাবুন নিকাহ)। ৩. স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। সামর্থ্য ও প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করা স্বামীর কর্তব্য। স্বামীর সাধ্য ও স্ত্রীর চাহিদার ভিত্তিতে এ ভরণ-পোষণ কম বেশি হতে পারে। অনুরূপভাবে সময় ও স্থানভেদে এর মাঝে তারতম্য হতে পারে। মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, বিত্তশালী স্বীয় বিত্তানুযায়ী ব্যয় করবে। আর যে সীমিত সম্পদের মালিক সে আল্লাহ প্রদত্ত সীমিত সম্পদ থেকেই ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে পরিমাণ দিয়েছেন, তারচেয়ে বেশি ব্যয় করার আদেশ কাউকে প্রদান করেন না (সুরা : তালাক, আয়াত : ৭)। ৪. স্ত্রীর প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু থাকতে হবে : স্ত্রীর প্রতি রূঢ় আচরণ করা যাবে না। তার সহনীয় ভুলসমূহকে ক্ষমা করে ধৈর্যধারণ করা। স্বামী হিসেবে সবার জানা উচিত, নারীরা মর্যাদার সম্ভাব্য সবকটি আসনে অধিষ্ঠিত হলেও, পরিপূর্ণরূপে সংশোধিত হওয়া সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও। কারণ, তারা পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্ট। পাঁজরের ওপরের হাড়টি সবচেয়ে বেশি বাঁকা। (যে হাড় দিয়ে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে)। তুমি একে সোজা করতে চাইলে, ভেঙে ফেলবে। আবার এ অবস্থায় রেখে দিলে, বাঁকা হয়েই থাকবে। তাই তোমরা তাদের কল্যাণকামী হও এবং তাদের ব্যাপারে সৎ-উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সহিহ বুখারি)। ৫. স্ত্রীর প্রতি যত্নশীল ও সতর্ক হওয়া : হাতে ধরে ধরে তাদেরকে হেফাজত ও সুপথে পরিচালিত করা। কারণ, তারা সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল, স্বামীর যেকোনো উদাসীনতায় নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ কারণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীর ফিতনা থেকে খুব যত্নসহকারে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, আমার অবর্তমানে পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর কোনো ফিতনা রেখে আসিনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৪৭০৬)। ৬. স্ত্রীর প্রতি আত্মমর্যাদাশীল হওয়া : স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আত্মম্ভরিতার প্রতি লক্ষ্য করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা সা’আদ এর আবেগ ও আত্মসম্মানবোধ দেখে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছো। আমি তার চেয়ে বেশি আত্মসম্মানবোধ করি, আবার আল্লাহ আমার চেয়ে বেশি অহমিকা সম্পন্ন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৭৫৫)। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, যার মাঝে আত্মমর্যাদাবোধ নেই সে দাইয়ুছ (অসতী নারীর স্বামী, যে নিজ স্ত্রীর অপকর্ম সহ্য করে)। হাদিসে এসেছে : ‘দাইয়ুছ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (দারামি : ৩৩৯৭)। দাইয়ুছ শব্দটি আরবি। শাব্দিক অর্থ হলো : অসতী, বেহায়া, বেশরম, নির্লজ্জ, বিবেকহীন, মূর্খ, আত্মমর্যাদাহীন ইত্যাদি। আর পারিভাষিক অর্থ হলা : যে ব্যক্তি তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের জিনা-ব্যভিচার ও অশ্লীল কাজকর্ম সে ভালো মনে করে গ্রহণ করে অথবা প্রতিবাদ না করে চুপ থাকে।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিন আত্মমর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়। আল্লাহতায়ালা সর্বাধিক আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৭৪৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে : বেহায়া হলো সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারে কে প্রবেশ করল এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করে না। (বায়হাক্বি, শু’আবুল ঈমান হাদিস নং ১০৮০০)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির জন্যে আল্লাহতায়ালা জান্নাত হারাম করেছেন- নেশাদার দ্রব্যে আসক্ত ব্যক্তি, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান এবং দাইয়ুছ। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ৫৮৩৯)।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও একজন স্বামীর ওপর স্ত্রীর আরো কিছু হক বা অধিকার রয়েছে যেগুলো এখন তুলে ধরা হবে : ক. সামর্থ্য অনুযায়ী ভরণ-পোষণ ও খরচাদি দিতে কোনো প্রকার অবহেলা না করা। খ. স্ত্রীকে দ্বীনি মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা প্রদান করা। গ. ভালো কাজের প্রতি উদ্ভূত করা। ঘ. যাদের সঙ্গে দেখা দেয়ার ব্যাপারে ইসলামের অনুমতি রয়েছে, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ প্রদান করা। ঙ. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদ প্রদান করা। চ. কোনো প্রকার ভুল বা অসাবধানতা হলে ধৈর্য ধারণ করা। ছ. শাসন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা। জ. মোহরানা আদায় করা। ঞ. ইসলামী শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে স্ত্রীর মন জয় করা। ট. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে সমতা বজায় রাখা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল ইসলাম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, সাভার, ঢাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads