• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

রক্তে কেনা মাতৃভাষা

  • প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুফতি উবায়দুল হক খান

 

 

 

বাংলা ভাষা। মাতৃভাষা। আমার মায়ের ভাষা। রক্তে কেনা মাতৃভাষা। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যময় ও গৌরবময় অর্জন মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা, ভাষা আন্দোলন। এর মূল্যবোধ এবং স্বাধীনতার ওপর তার প্রকৃষ্ট প্রভাব অনস্বীকার্য। কেবল তা-ই নয়, ভাষার জন্য আন্দোলন করে এরূপ জীবন উৎসর্গ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল বহু আগে। অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি [৮ ফাল্গুন ১৩৫৮] এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র ও কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকতসহ আরো অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে যায়। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রতি বছর গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।

ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি আমাদের কাছে ঐতিহ্যময় দিবস। বিগত এক দশক ধরে এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত সারা বিশ্বে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায় বাঙালি জাতির জন্য এ দিনটি বাড়তি একটি গর্ব বয়ে এনেছে সুনিশ্চিতভাবেই। ১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা দিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের কাছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ভাষা হলো আমাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ঐতিহ্য আর উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপকরণ। মাতৃভাষা বিস্তারের উন্নতিতে সব ধরনের কর্ম কেবল ভাষাগত ডাইভারসিটি এবং বহুভাষাগত শিক্ষার প্রতিই উৎসাহিত করে না; বরং বিশ্বজুড়ে ভাষাগত সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক প্রথার প্রতি পূর্ণ সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং বোঝাপড়া, উদারতা ও কথাবার্তার ওপর নির্ভর সহমর্মিতার প্রতি উৎসাহিত করে। দুঃখের কথা বলে শেষ করছি, যে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যময় আন্দোলনের দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করা হয়েছে সে ভাষাতেই ওয়েবসাইটটি পড়া যায় না, যদিও ইংরেজি, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, আরবি, চাইনিজ ইত্যাদি ভাষায় ওয়েবসাইটটি পড়া যায় ঠিকই।

 

লেখক : মুহাদ্দিস ও সহকারী শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads