• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

বাংলিশ ব্যবহার কাম্য নয়

  • প্রকাশিত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুফতি উবায়দুল হক খান

 

 

 

প্রতিটি মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে তার মাতৃভাষা। মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে চিন্তা-ভাবনা, নতুন জিনিস উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করার ক্ষমতা দান করেছেন। সেই সাথে পরস্পরে মনের ভাব প্রকাশের জন্য শিক্ষা দিয়েছেন মুখের ভাষা। তাই মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য মাতৃভাষাই হচ্ছে সর্বোত্তম মাধ্যম। মাতৃভাষায় যত সহজে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, অন্য যে কোনো ভাষায় তত সহজে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে দিকে লক্ষ করেই আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সুরা রুমে ইরশাদ করেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণবৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’

আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই স্ব-স্ব গোত্রীয় ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। যাতে উম্মতেরা তাঁদের কথা বুঝতে পারে। আর সুরায়ে আর রাহমানে ইরশাদ হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা ও ভাব প্রকাশের কলা-কৌশল।’ এখানে ভাব প্রকাশের যে কলা-কৌশলের কথা বলা হয়েছে, তা হলো মানুষের মুখের ভাষা। যা মানব সমপ্রদায়ের জন্য স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ দান। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের জন্য বাংলা ভাষা। যা বাংলার বীর দামাল ছেলেরা আন্দোলনের মাধ্যেমে রক্ত ঝরিয়ে অর্জন করেছেন। মাতৃভাষা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে ভাষার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেওয়ার মতো বিরল ঘটনা।

১৩৫৯ সালের ৮ ফাল্গুন মোতাবেক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এদেশের গৌরব রফিক, বরকত, সালাম জাব্বারসহ আরো নাম না জানা বীর ছাত্র-যুবকসহ অনেকেই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, বাঙালিরা যে ভাষা রক্ষার্থে বিলিয়ে দিয়েছিল নিজেদের তাজাপ্রাণ, আজ তাদেরই ছেলেরা সেই ভাষাকে বিকৃতি করে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে ইংরেজি দ্বারা। যেই ভাষার জন্য উৎসর্গিত হয়েছে আমাদের ত্রিশ লক্ষ প্রাণ, যেই ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছিল বীর বাঙালিরা, সেই ভাষা দিবস আজ পালন করা হচ্ছে ইংরেজি তারিখে।

হায়রে আধুনিকতার অপব্যবহার! হায়রে সংস্কৃতির বিনাশ! কী ঘটছে বাংলা ভাষায়? কী হচ্ছে বাঙালিদের? কিই বা ছিল বাঙালিদের বিশ্ব জয়ের লক্ষ? কী উদ্দেশ্য ছিল ভাষা আন্দোলনের? যেই বাঙালিদের আত্মত্যাগের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাভাষা, আজ সেই বাঙালিদের বংশধররা আপন মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করছে ভাষা দিবস হিসেবে। জানি না কী তাদের উদ্দেশ্য? কী-ই বা তাদের আশা। তাদের ইচ্ছা কি ভাষাকে সমৃদ্ধশীল করা, নাকি ভাষার মান ক্ষুণ্ন করা? যদি তাই না হয়, তবে কেন দৈনন্দিন কথাবার্তার প্রতিটি বাক্যে স্থান দেওয়া হয় ইংরেজি ভাষাকে? কেন বলা হয় ‘উদ্দেশ্য’-এর স্থলে ‘টার্গেট’? কেনই বা বলা হচ্ছে- ‘অতিথি বা মেহমান’-এর স্থানে ‘গেস্ট’? কেন ‘পরিবার’-কে বাদ দিয়ে ‘ফ্যামিলি’ বলা হয়? কেন ‘উপহার’ না দিয়ে দেওয়া হচ্ছে- ‘সারপ্রাইজ’? কেন কেনাকাটা বা বাজার না করে করা হচ্ছে- ‘শপিং’? কেন ‘রকম’-এর জায়গায় ‘আইটেম’ না বললেই নয়? কেন আমরা কোনো কাজে ‘সাফল্য’ না হয়ে হই ‘সাকসেসফুল’? কেন ‘পরিকল্পনা’-এর জায়গায় করা হয় ‘প্ল্যান’? যদি এসব প্রশ্ন আজ সমাজের মানুষকে করি, তাহলে তারা নিশ্চয় বিদ্রূপের হাসি হেসে বলবে, এগুলো তো ব্যবহার করা হয় ভাষাকে সমৃদ্ধশীল করার জন্য। কিন্তু যদি বলি, প্রয়োজনে কোনো বিদেশি শব্দ দিয়ে লেখা দূষণীয় নয়, তবে তা কেবল প্রয়োজনে। কিন্তু অপ্রয়োজনে ও অযথা কেন এত বাড়াবাড়ি? কেন বিনা প্রয়োজনে ইংরেজি শব্দের এত ছড়াছড়ি?

আমরা বাঙালি। আমাদের ভাষা বাংলা। আমাদের জন্য রয়েছে বাংলা সন। আর এই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ১৩৫৯ সালের ৮ ফাল্গুন। সেই আলোকে আমাদের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ৮ ফাল্গুন হওয়া কী যুক্তিসঙ্গত ছিল না? তা না হয়ে কেন আজ একুশে ফেব্রুয়ারি করা হলো?  কী-ই বা উদ্দেশ্য তাতে? এমনটা কী আমাদের জন্য অপমানের বিষয় নয়? এটা কী আমাদের বাংলাভাষার জন্য মানহানির ব্যাপার নয়? হে বাঙালি! তোমার কি ইচ্ছে জাগে না বাংলা ভাষাকে পরিপূর্ণরূপে চর্চা করার এবং তা বিশ্বের মাঝে প্রচার-প্রসার করার? তাহলে তুমি কেন আজ ইংরেজি নিয়ে এতো ব্যস্ত? কেন তুমি ইংরেজিকে বাংলার ওপর প্রাধান্য দেবে? তুমি কেন ইংরেজিকে বাংলাভাষায় সংমিশ্রণ ঘটাবে?

ইংরেজি লেখকরা তোমার ভাষাকে তাদের ভাষায় কতটুকু স্থান দিয়েছে? কয়টি বাংলা শব্দ লিখেছে তাদের রচনাবলিতে? আমি জানি, তুমি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারবে না। কারণ তুমি অধম। তুমি নীচু। তুমি হীনমন্য। এটাতো ঠিক সেই উদাহরণের ন্যায়, নিজ মাতাকে পরিত্যাগ করে শাশুড়ি নিয়ে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হওয়া। তুমি মায়ের ভাষাকে পরিত্যাগ করে বিদেশি সংস্কৃতির অপব্যবহার করছো। ধিক! শত ধিক তোমাকে!! বস্তুত আমাদের ভাষাকে আমরা কীভাবে মর্যাদাশীল করব তা আমাদেরই ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল। হে বাংলিশ ব্যবহারকারীরা! কবে তোমাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে? কবে তোমরা বাংলাভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে? আমার বিশ্বাস, তোমার সঠিক জ্ঞানে তুমি চাইবে বাংলাভাষার বিজয়। আশা করি তুমি সম্বিৎ ফিরে পাবে।

 

লেখক : মুহাদ্দিস ও সহকারী শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads