• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
রমজানের মাহাত্ম্য ও করণীয়

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

রমজানের মাহাত্ম্য ও করণীয়

  • প্রকাশিত ১৬ এপ্রিল ২০২১

রমজান অর্থ ঝলসিয়ে দেওয়া, জ্বালিয়ে দেওয়া। এই নামকরণের কারণ হলো, সর্বপ্রথম যখন এ মাসের নাম রাখা হয় সে বছর এই মাসে খুব ভেঁপসা গরম ছিল। এই জন্য লোকেরা তার নাম রেখেছে রমজান। উলামায়ে কেরাম বলেন, এ মাসকে রমজান বলার কারণ হলো, এ মাসে আল্লাহতায়ালা তার দয়া ও অনুগ্রহের মাধ্যমে  বান্দার গুনাহগুলো ঝলসিয়ে দেন। জ্বালিয়ে দেন। এগারো মাস দুনিয়ার কাজকর্মে লেগে থাকার ফলে অলসতা অন্তরে ছেয়ে গিয়েছিল। এ সময়ে যেসব গুনাহ ও ভুল করেছ সেগুলো নিয়ে রবের দরবারে হাজির হয়ে ক্ষমা করিয়ে নাও। অলসতার পর্দা অন্তর থেকে উঠিয়ে দাও। যেন জীবনের এক নতুন ধাপ শুরু হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এই সিয়াম তোমাদের ওপর এজন্য ফরজ করা হয়েছে যাতে তোমাদের মধ্যে  আল্লাহভীতি সৃষ্টি  হয়।’

সাধারণত  মনে করা হয়, রমজান মাসের বৈশিষ্ট্য এই যে, দিনে রোজা রাখবে; রাতে তারাবি পড়বে। এছাড়া আর কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এই দুই ইবাদত এ মাসের বড় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু এ পর্যন্তই শেষ নয়। বাস্তবে রমজান আমাদের থেকে আরো অনেকগুণ বেশি কিছু চায়। রমজান মাসের আসল উদ্দেশ্য  হলো, সারা বছরের গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নেওয়া। অলসতার পর্দা অন্তর থেকে উঠিয়ে দেওয়া এবং অন্তরে তাকওয়া  সৃষ্টি করা। কোনো মেশিন কিছুদিন ব্যবহারের পর যেমন সার্ভিস করাতে হয় তেমন আল্লাহতায়ালাও  মানুষের সার্ভিসিংয়ের জন্য রমজানকে নির্ধারণ করেছেন। যেন গুনাহ মুক্ত হয়ে নিজের জীবনে নতুনত্ব নিয়ে আসতে পারে।

রমজানকে স্বাগতম জানানোর প্রথা অনেক জায়গায় শুরু হয়েছে। রমজানকে স্বাগত জানানোর এই আগ্রহ খুব ভালো। কিন্তু এটা যখন আরো সামনে অগ্রসর হতে থাকবে তখন  তা বেদআত রূপ ধারণ করবে। কোনো কোনো এলাকায় ইতিমধ্যে তা বেদআতে রূপ নিয়েছে। এব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আমার নিকট রমজানকে স্বাগত জানানোর সঠিক পদ্ধতি হলো, রমজানের পূর্বেই রুটিনকে এমনভাবে তৈরি করা যেন পুরো সময়কে ইবাদতে কাটানো যায়। তা না পারলে যে কাজগুলোকে এক মাসের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় সেগুলোকে ছেড়ে দেওয়া। কোনো কাজ কমিয়ে আনা সম্ভব হলে কমিয়ে আনা। যেসব কাজকে রমজানের পর পর্যন্ত বিলম্ব করা যায়  সেগুলোকে বিলম্ব করে দেওয়া। এভাবে রুটিন করলে রমজানের সঠিক রুহ,  নূর ও বরকত অর্জন হবে। নতুবা রমজান আসবে আর চলে যাবে। সঠিকভাবে উপকৃত হওয়া সম্ভব হবে না।

সব প্রকার নফল ইবাদত, নফল নামাজ ও জিকির-আজকার থেকে এ মাসে অগ্রগণ্য ইবাদত হলো ‘পুরো মাস গুনাহমুক্ত থাকা’। যে এমাসে চোখ, কান, মুখ ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে অবাধ্যতা থেকে বিরত রাখে। নফল নামাজ, অতিরিক্ত তেলাওয়াত ও জিকির-আজকার নাও করে তবুও সে বিশেষ সুসংবাদের অধিকারী হবে। লক্ষ করুন! পানাহার ও স্ত্রীসঙ্গম রোজা ব্যতীত অন্যসময় হালাল। রোজা অবস্থায় এ হালাল তিনটি জিনিসকেও হারাম করা হয়েছে। কিন্তু কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো রোজাতেও হারাম রোজার বাইরেও হারাম। যেমন মিথ্যা বলা, গিবত করা, কুদৃষ্টি দেওয়া, সুদ ও ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি। অন্যসময় যা হালাল এ সময়ে তা আমরা ছাড়তে পারলেও যা সবসময় হারাম রমজানে এসেও আমরা অনেকেই তা ছাড়তে পারছি না। এজন্যই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন; যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় মিথ্যা বলা ছাড়বে না তাহলে তাকে আমার ক্ষুধার্ত  এবং পিপাসার্ত রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারি ও মুসলিম) যদি মুফতি সাহেবকে কেউ জিজ্ঞাসা করে  আমি রোজা রেখেছি, মিথ্যাও বলেছি তাহলে মুফতি সাব উত্তর দেবেন, রোজা হয়ে গেছে। পুনরায় তা করতে হবে না।

তবে তা কাজা ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও  এই রোজার সওয়াব  ও বরকত পদদলিত হয়ে গেছে। এ হিসেবে এ ধরনের রোজার  কোনো রুহ লাভ হয় না।

রোজা কেন ফরজ করা হয়েছে? রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেন তার মাধ্যমে আমাদের অন্তরে ‘তাকওয়া’ তথা আল্লাহর ভয় প্রজ্বলিত হয়। রোজার মাধ্যমে তাকওয়া কীভাবে অর্জন হবে? এভাবে যে, রোজা মানুষের পশুশক্তি ভেঙ্গে দেয়। যখন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে তার মাধ্যমে তার পাশবিকতা পদদলিত হবে। যার ফলে গুনাহের দিকে অগ্রসর হওয়ার আগ্রহ দমে যাবে। আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, যখন মানুষ ভালোভাবে রোজা রাখবে তখন এই রোজাই তাকওয়ার এক বড় সিঁড়ি। কারণ তাকওয়ার অর্থ  হলো, আল্লাহর বড়ত্বের কথা স্মরণ করে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। চিন্তা করা যে, আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে দেখছেন। তাঁর সম্মুখে আমাকে হাজির হতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে। এই কল্পনার পর মানুষ যখন গুনাহ ছেড়ে দিবে এর নামই হলো তাকওয়া। রোজা অনেকটা এয়ারকন্ডিশনের মতো। যদি এয়ারকন্ডিশন চালু রাখা হয় আবার দরজা জানালাও খোলা রাখা হয় তাহলে একদিক দিয়ে বাতাস আসে আরেক দিক দিয়ে চলে যায়। এজন্য  পরিপূর্ণভাবে এয়ারকন্ডিশন থেকে ফায়দা হাসিলের জন্য সব দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হয়। তদ্রূপ রোজা অবস্থায়েও  নাফরমানি ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকতে হয়। তা না হলে পরিপূর্ণ তাকওয়া ও বরকত অর্জন হবে না।

রোজার মূল হেকমত হচ্ছে আল্লাহর হুকুম অনুসরণ করা। এজন্যই  সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি ইফতার করা মুস্তাহাব। ওজর ব্যতীত ইফতার বিলম্ব করা মকরুহ। যখন সূর্য অস্তমিত হয়েছে তখন আমাদেরকে এই হুকুম দেওয়া হয়েছে এখন যদি তোমরা না খেয়ে ক্ষুধার্থ থাক তাহলে এ ক্ষুধার্থতা আমার অপছন্দ। কারণ আমাদের মূলকাজ হচ্ছে  আল্লাহর হুকুমের অনুসরণ করা। নিজের আগ্রহ পূর্ণ  না করা। ইফতার তাড়াতাড়ি করার কারণ এই যে, সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বেই এই হুকুম এসেছিল যে, এক বিন্দু পরিমাণও যদি মুখে চলে যায় তাহলে গুনাহও হবে, কাফফারাও ওয়াজিব হবে। যেমন সাতটায় সূর্য অস্তমিত হয়  এখন যদি কেউ  ৬ : ৫৯  মিনিটে একটি বুট খেয়ে ফেলল তাহলে তার এক মিনিটের রোজা ভেঙে গেছে। কিন্তু এই এক মিনিটের রোজা ভাঙ্গার দরুন ষাটটি রোজা রাখা ওয়াজিব হবে।

কারণ, বিষয়টি শুধু একটি বুট আর এক মিনিটের না। মূলকথা হলো, সে হুকুম ভঙ্গ করেছে। হুকুম ছিল-সূর্য অস্তমিত না হওয়া পর্যন্ত  কোনো খাবার না খাওয়া। যেহেতু হুকুম ভঙ্গ হয়েছে  কাজেই এখন  এক মিনিটের পরিবর্তে ষাট দিন রোজা রাখতে হবে।

সাহরি বিলম্বে খাওয়া উত্তম। তাড়াতাড়ি খাওয়া সুন্নাতের পরিপন্থি। যদি কেউ রাত বারোটায় সাহরি খেয়ে শুয়ে পড়ে এটা সুন্নাতের পরিপন্থি হবে। সাহাবায়ে কেরামের আমল ছিল একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত  সাহরি খাওয়া। কারণ সে সময় আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে শুধু খাওয়ার অনুমতিই না বরং খাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। এ কারণে যতক্ষণ পর্যন্ত সে সময় বাকি থাকবে আমরা খেতে থাকব। এতেই আল্লাহর হুকুমের অনুসরণ ও অনুকরণ হবে।

রমজানের গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়গুলোর অন্যতম  একটি হলো, হারাম রিজিক পরিত্যাগ করা। হালাল খাওয়া।

এ কেমন রোজা! যার সাহরিও হারাম। ইফতারও হারাম। আর এ দুয়ের মাঝে রোজা। তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে, আমি হালাল  রিজিক চাই। আমাকে হারাম রিজিক থেকে রক্ষা করুন। প্রফেসর ডা. আব্দুল হাই (রহ.) বলেন, যদি কেউ সুদি প্রতিষ্ঠানে চাকরি  করে  আর তার সব উপার্জনই হারাম হয় তাহলে সম্ভব হলে  এ মাসে এ চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে নিবে। হালাল পদ্ধতিতে কিছু করার চেষ্টা  করবে। যদি সম্ভব না হয়,  এ মাসের খরচের জন্য কারো থেকে ঋণ নিবে। চিন্তা করবে যে, আমি এ মাসে হালাল উপার্জন করব। স্ত্রী, সন্তানদেরকেও হালাল খাওয়াব।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এটি সাম্যের মাস। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের মাস। কাজেই  ক্রোধ  ও ক্রোধের কারণে  যেসব অপরাধ প্রকাশ  হয় সেগুলোও গোনাহ। যেমন, ঝগড়া, মারপিট ইত্যাদি। এগুলো থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। রমজানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো কোরআন জিবরাইল (আ.)কে  বারবার তেলাওয়াত করে শুনাতেন। এজন্য যত বেশি সম্ভব এ মাসে কোরআন তেলাওয়াতে মনোযোগী হতে হবে। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর, দরুদ, ইস্তিগফার, তাহাজ্জুদ ও অন্য নফল ইবাদত বেশি বেশি করতে হবে। এসবগুলোই  রমজানের বৈশিষ্ট্য। তবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। (ইসলাম ও আমাদের জীবন বই অবলম্বনে)

লেখক :মুজীব রাহমান

আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads