• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
শরীরের জাকাত রমজানের রোজা

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

শরীরের জাকাত রমজানের রোজা

  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০২১

ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ হলো মুমিন-মুসলমানের জন্য অবশ্যই পালনীয় আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে রমজান মাসের রোজা। আরবি মাসসমূহের নবম মাস হলো পবিত্র রমজান মাস। রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি পরিভাষা হলো সাওম। আরবিতে বহুবচনে বলা হয় সিয়াম। সাওম অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা, সংযত হওয়া। পরিভাষায় সাওম হলো আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি কামনায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার-স্ত্রীসহবাস থেকে বিরত থাকা। আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য রোজা ফরজ করেন দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হলো যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো, পরহেজগার হতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)

এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় এবং বোঝা যায়, রোজার বিধান দেওয়া হয়েছে তাকওয়া অর্জনের জন্য, গোনাহ ত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতের উপযোগী হওয়া এবং নিজেকে আত্মশুদ্ধ ও পরিশুদ্ধ করার জন্য।

রমজানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহতায়ালা এ মাসটিকে তাঁর নির্দেশিত ওহি সহিফা ও আসমানি কিতাব প্রেরণের জন্য মনোনীত করেন। অধিকাংশ আসমানি কিতাব রমজান মাসে অবতীর্ণ করা হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত, ‘হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সহিফা রমজানের ১ তারিখে, তাওরাত রমজানের ৬ তারিখে, জাবুর রমজানের ১২ তারিখে, ইঞ্জিল রমজানের ১৮ তারিখে এবং সর্বশেষ কোরআনে মাজিদ (রমজান মাসের) পবিত্র কদরের রাতে অবতীর্ণ হয়েছে।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এই  কোরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছি।’ রমজান মাসের রোজা পালনকে ফরজ বিধান করে আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন, ‘রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে। এই  কোরআন মানবজাতির জন্য পথের দিশারী, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে সে এতে রোজা রাখবে। যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে, সে পরবর্তী সময়ে গু​নে গুনে সেই পরিমাণ দিন রোজা রেখে পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না, যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হিদায়াত দান করার দরুন আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনার পর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।’

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মানুষের প্রত্যেক আমলের সাওয়াব দশ গুণ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রোজা এ নিয়মের ব্যতিক্রম, কেননা রোজা বিশেষভাবে আমার জন্য আমি নিজেই তার প্রতিদান দেব, বান্দা তার পানাহার ও কামনা-বাসনাকে আমার সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছে।’ (সহিহ মুসলিম) বুখারি শরিফের এক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, সিয়াম এবং কোরআন হাশরের ময়দানে আল্লাহতায়ালার বান্দা-বান্দির জন্য সুপারিশ করবে এবং আল্লাহতায়ালা তাঁদের উভয়ের সুপারিশ কবুল করবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) আরো বর্ণনা করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুর জাকাত রয়েছে, তেমনিভাবে শরীরেরও জাকাত আছে। শরীরের জাকাত হলো রমজানের রোজা পালন করা। অর্থাৎ জাকাতদানে যেভাবে মালের পবিত্রতা অর্জন হয়, তেমনিভাবে রোজা পালনের মাধ্যমে শরীর পবিত্র হয় এবং গোনাহ মাফ হয়।’

রমজান মাসে রোজা রেখে সব ধরনের গোনাহ বর্জনের অঙ্গীকার করতে হবে। রমজান মাসের শুরুতে আল্লাহতায়ালা জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন। জান্নাতের দরজা খুলে দেন। আর শয়তানকে শিকলবন্দি করেন। তাই শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়। তাই মুমিন নেক কাজে অগ্রগামী হতে পারে। আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদের অনেক জায়গায় শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু বলে ঘোষণা করেছেন। শয়তান তোমাদের শত্রু, তাকে শত্রু হিসেবেই গ্রহণ করো। সে চায় মানুষের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করা, মদ-জুয়ায় নিমগ্ন করা, মিথ্যা বলায় উদ্বুদ্ধ করা, এককথায় যাবতীয় খারাপ কাজে জড়িত করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও বাজে কাজ পরিত্যাগ করল না, তার রোজা রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।’ তাই শয়তানের কাজ থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। আমাদেরকে বেশি বেশি আল্লাহতায়ালার সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।

আল্লাহতায়ালা রোজাদারের জন্য জান্নাতে বিশেষ দরজা রেখেছেন। হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “জান্নাতের আটটি দরজা আছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম হলো ‘রাইয়ান’। এ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদার প্রবেশ করবে। অন্যরাও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইবে। কিন্তু রোজাদার ব্যতীত অন্য কাউকে এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।” (বুখারি ও মুসলিম) রোজাদারের জন্য রয়েছে দুটি সীমাহীন আনন্দ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে, একটি তার ইফতারের সময়, অপরটি হলো আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য বা সাক্ষাতের সময়।’ হাদিসে আরো উল্লেখ রয়েছে। ইফতারের সময় দোয়া কবুলের সময়। আল্লাহতায়ালা রোজাদারের দোয়া কবুল করেন।

রমজানের বিশেষ রাত লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদর হলো এমন একটি রাত, যে রাতে ইবাদত-বন্দেগি করলে এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে পবিত্র  কোরআনে বলা হয়েছে। এক হাজার মাসের হিসাব করলে কদরের এক রাতের ইবাদত ৮৬ বছর ৪ মাসের সমান। তবে আল্লাহতায়ালা তার চেয়েও বেশি বা উত্তম বলেছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, যে ব্যক্তি কদরের রাতে সাওয়ারের আশায় ইবাদত করবে, তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। উম্মুল মুমিনিন আম্মাজান হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কদরের রাত পাই, তাহলে আমি কী দোয়া পড়ব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’-এই দোয়া পড়বে।’ অন্য হাদিসে আছে, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখ) শবে কদর সন্ধান করো।’ রমজানের একটি বিশেষ আমল হলো তারাবির নামাজ। এশার নামাজের (ফরজ ও সুন্নতের) পর বিতরের আগে দুই রাকাত করে মোট ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। সম্ভব হলে খতম তারাবি আদায় করা উত্তম। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে নেকির আশায় কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

রমজানে ইতিকাফ : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়া আনতুম আকিফুনা ফিল মাসজিদ’ তোমরা মসজিদে ইতিকাফ করো। ইতিকাফ শব্দের অর্থ নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ হলো, আল্লাহতায়ালার রাজি-খুশি, সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের আশায় শর্তসাপেক্ষে নিয়তসহকারে মুমিন পুরুষেরা মসজিদে ও মুমিনা নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করবে। রমজানের শেষ দশক (২০ রমজান থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত) ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। বিনা প্রয়োজনে অর্থাৎ গোসল, খাবার, বিশেষ জরুরত ব্যতীত অন্য কোনো অজুহাতে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করা যাবে না। ইতিকাফ অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও নফল নামাজে সময় অতিবাহিত করতে হবে।

হাসান মাহমুদ

লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads