• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
পরিবার-সমাজে ইসলামের অনুশীলন

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

পরিবার-সমাজে ইসলামের অনুশীলন

  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০২১

মাওলানা ফয়জুল আমিন

ইসলামি খেলাফত ধ্বংসের একশত বছর পর আজও আমরা মুসলিম সমাজের নেতৃত্বের আসনে আমাদের ওলামায়ে কেরামকে সমাসীন করতে পারিনি। তাই আমরা ইসলামী খেলাফত ফিরিয়ে আনতে পারছি না। এমনকি আমাদের সমাজে কিছু সামাজিক ঐতিহ্য ছিল, যা ছিল ইসলামী সমাজের অবশিষ্টাংশ। আর এগুলো আমাদের থেকে খুব দ্রুত বিদায় নিয়েছে। সব হারিয়েও কোথাও কোথাও যৌথ পরিবার দেখা যেত। যে পরিবারগুলোর সন্তানেরা বেশি মানুষের সাথে মিলে মিশে বড় হওয়ায় তারা খুব বেশি সামাজিক হয়ে বেড়ে উঠতো। মুরুব্বিদের তত্ত্বাবধানে থাকায় পূর্বপুরুষদের মন মানসিকতা লাভ করতো। যা ইসলামী শরিয়তের প্রতি আনুগত্যশীল থাকতে উৎসাহিত করতো। এখন গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র পরিবার বা একক পরিবার। আর এ পরিবারগুলোতে মা-বাবা ছাড়া অন্য কোনো মুরুব্বি না থাকায় তারা অতটা সামাজিক হতে পারছে না। তাদের উপযুক্ত তালীম তরবিয়ত হচ্ছে না। ব্যস্ত মা-বাবার আদর সোহাগে প্রতিপালিত এসব মুসলিম শিশুদের মন ও মনন আচরণ এবং উচ্চারণ গড়ে উঠছে কার্টুন ও নভেল নাটক অর্থাৎ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। আর এগুলো তৈরিতে অর্থায়ন করছে খ্রিস্টান মিশনারিগুলো। চলচ্চিত্র বলতে আমরা বুঝি দেশ জাতি বা সমাজের চলমান চিত্র। কিন্তু বর্তমানে চলচ্চিত্র হলো এমন বিনোদন ব্যবস্থা, যা নীরবে নিভৃতে সমাজকে প্রভাবিত করে সমাজের গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে। পাল্টে দিচ্ছে মুসলিমদের লাইফস্টাইল। আর সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে শিশু ও উঠতি বয়সি যুবকেরা। তারা তাদের বাবা-মা ও পূর্বপুরুষদের চিন্তা-চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়ায় তাদের নীতি নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ হচ্ছে একেবারে নিম্নমানের। তাই পরিবার ও সমাজে ভাঙন ধরেছে। সবাই হয়ে যাচ্ছে আত্মকেন্দ্রিক। এমনকি এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে গ্রামগুলোও রেহাই পাচ্ছে না। যেখানে পৌঁছে গেছে ডিশ বা টেলিভিশন।

অনেকেই ভাবতে পারেন, চাকরি বা ব্যবসার সুবাদে কিছু লোকেরা গ্রাম থেকে শহরে আসার কারণে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র পরিবার কিন্তু গ্রাম ছেড়ে আসার পরও যারা গ্রামের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করে মা-বাবার প্রতি যে দায়িত্ব আছে তা আদায় করে এবং সন্তানদেরকে বয়োজ্যেষ্ঠদের সাহচার্যে নিয়ে যায়। তাদের পারিবারিক বন্ধনে কোনো শিথিলতা আসছে না। কিন্তু এমন শহুরে পরিবার এখন আর দেখা যায়না বললেই চলে। শুধু তাই নয়, আজ দেশ ও জাতির রন্দ্রে রন্দ্রে খ্রিস্টান মিশনারিদের নাপাক হস্থক্ষেপের আলামত দেখা যাচ্ছে। খ্রিস্টান মিশনারিদের অপতৎপরতা থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে হলে ভেঙে পড়া সামাজিক অবকাঠামো ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সংগঠিত করার বিকল্প নেই। একটি সম্মিলিত শক্তির দ্বারা ইসলামী সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে আশার কথা হলো, এখনো আমাদের দেশে মাদরাসার পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে, সিয়াসাতের ময়দানে আলেমদের অবস্থান মজবুত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উম্মতের একদল লোক দীন কায়েমের জন্য নজিরবিহীন ত্যাগ স্বীকার করে চলেছে। খানকাহি মেহনত পুনরুদ্যমে এগিয়ে চলছে। দাওয়াতি ময়দান দিন দিন সমপ্রসারিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় মাদরাসার তলাবাবৃন্দ উলামায়ে কেরাম এবং সমমনা ব্যক্তিবর্গ একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে খেদমতে খলকের কাজ আঞ্জাম দেয়, তাহলে আমাদের সমাজের ক্যানসার তথা খ্রিস্টান মিশনারিগুলোকে সমাজে অপ্রয়োজনীয়, অপাংক্তেয় ও ঘৃণার বস্তু করে তোলা সম্ভব। আর এই ক্যানসারগুলোকে দূর করতে পারলে, ইরতেদাদের নিকৃষ্ট ফেতনাও বন্ধ হবে। আর আমরা খুব সহজে ইসলামী ব্যবস্থা গঠন করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।

আমরা জানি সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট হলো পরিবার যা শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ । তাই আমাদেরকে সর্বাগ্রে পরিবারের প্রতি নজর দিতে হবে। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন সুরা তাহরিমের ৬নং আয়াতে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেরা বাঁচ এবং তোমাদের পরিবারকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও’। হজরত ক্বাতাদা (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া, আল্লাহর নাফরমানি থেকে নিষেধ করা। আর আল্লাহর নির্দেশ তাদের ওপর বাস্তবায়ন করা। তাদেরকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া এবং তাদেরকে সুসংবাদ শুনানো। আর যখনই আল্লাহর নাফরমানি হতে দেখবে অবশ্যই নাফরমানি সম্পর্কে জোর দিয়ে বলবে এবং পীড়াপীড়ি করবে’।

উক্ত আয়াতে কারীমার আলোকে আমরা বুঝতে পারছি আমাদের পরিবার-পরিজনের ওপর আমাদের দাওয়াতি কাজ করতে হবে। আমাদের পরিবারগুলোকে আমরা কখনো বাঁচাতে পারবো না, যদি তাদের একে অপরের মধ্যে বিশ্বাস, সমপ্রতি, সচেতনতা এবং ফরজে আইন পরিমাণ ইলম তাদের না থাকে। তাই আমাদেরকে সমপ্রীতি বিশ্বাস সচেতনতা এবং অজ্ঞতা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একই পরিবারভুক্ত বিভক্ত ক্ষুদ্র পরিবারগুলোকে একত্রিত করা অথবা একই বাড়িতে অবস্থানরত সব পরিবারের প্রধান পুরুষদেরকে একত্রিত করা এবং হালাল-হারাম, প্রতিবেশীর হক, কর্জে হাসানার ফজিলত, হারাম বর্জনের উপকারিতা ও ফজিলত, বয়োজ্যেষ্ঠদের মূল্যায়ন ও তাদের সিদ্ধান্তের সম্মান দেখানো, নবীনদের ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলার ফিকির, দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করা, ঋণের প্রকার, ক্রয়-বিক্রয়ের প্রকার, সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবসা করার আর্থিক উপকারিতা ও পরকালীন লাভ এবং ভুল পদ্ধতিতে ব্যবসা করার ইহকালীন ক্ষতি ও পরকালীন ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা। আর্থিক উন্নতি, সুস্থতা, বিপদ মুক্তির জন্য ইজতেমায়ি দোয়া করা।

সমাজে ইসলামের অনুশীলনের জন্য সবার সাথে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষকে নিজেদের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা না করে আল্লাহর সাথে জুড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আর তখন নিজের সাথেও সম্পর্ক হয়ে যাবে। ভ্রাতৃত্বমূলক সুন্দর সম্পর্ক ও সমাজে ইসলামের অনুশীলনের জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপের আলোচনা করা হলো। ১. আলেমসমাজ, কওমি মাদরাসার তালাবাবৃন্দ এবং সমমনা ব্যক্তিবর্গদেরকে সংগঠিত করার জন্য চা-চক্রের আয়োজন করা। ২. সৌহার্দ্যমূলক কথাবার্তার মাধ্যমে ঘরোয়া পরিবেশে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। ৩. সামাজিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী হয় এমন মহব্বতপূর্ণ কথাবার্তার দ্বারা একটি প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচির ব্যবস্থা করা। ৪. নিজেকে নেতৃত্বের আসনে তালাশ না করে, অন্যদের মাঝে নেতা তালাশ করা। ৫. সমমনা ও সামাজিক দিক থেকে সমপর্যায়ের ব্যক্তি যারা একে অপরের প্রতি আস্থাশীল এমন ব্যক্তিদেরকে সংগঠিত করা। কাজের শৃংখলার জন্য কাজ বণ্টন করে নেওয়া। ৬. একই গ্রামের অধিবাসী এবং পাশাপাশি অবস্থানরত এমন ব্যক্তিদেরকে সংগঠিত করা।

৭. পুরুষ ও মহিলাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা। মহিলাদের দীন শিক্ষার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। ইন্সুরেনেন্সর সাথে জড়িত বা ব্যাংকে চাকরি করে এমন ব্যক্তিদেরকে সাথে না জড়ানো। তবে তারা সেবার আওতাভুক্ত থাকবে। ৮. উচ্ছৃঙ্খল দুঃশ্চরিত্রদেরকে জড়ানো যাবে না। ৯. প্রত্যেক সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ১০. ক্ষতিকর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে (যেমন-সুদ) জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদেরকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে। ১১. সেবা দেওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সঠিক পদ্ধতি এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করার ব্যাপারে জোরদার মেহনত করা। ১২. ফরজে আইন পরিমাণ জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করা ও অজ্ঞতা দূর করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক পদক্ষেপ হাতে নেওয়া। ১৩. ইসলামী শিক্ষা (বয়স্ক ও শিশু),স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, পরিবার, পরিবেশ এবং সঠিক পদ্ধতিতে চাষবাস, পশুপালন, মৎস্যচাষ ইত্যাদি বিষয়ে এলাকাবাসীকে সচেতন করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া। নির্দিষ্ট সময় পরপর খোঁজ-খবর নেওয়ার ব্যবস্থা করা। এসংক্রান্ত কর্মসূচিতে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করার ব্যাপারে জোর দেওয়া।

উপরিউক্ত বিষয়াদির পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় জোরদার করতে হবে। যেমন : সামপ্রদায়িক সমিপ্রতি রক্ষা করা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করা, অশ্লীলতা ও অনৈতিকতা দূর করা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধি করা। সমপ্রতি ও সুসম্পর্ক তৈরি করা এবং বিশ্বস্ততা অর্জন করা। সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, ভিক্ষুক, ভূমিহীন, শ্রমিক ইত্যাদি শ্রেণিপেশার লোকজন যারা একই বাড়িতে বসবাস করে বা একই এলাকায় বসবাস করে তাদেরকে দারিদ্র্যতা দূরীকরণের কর্মসূচিতে একত্রিত করা। উক্ত কর্মসূচিতে পারস্পরিক সমপ্রীতি, সুসম্পর্ক ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি, ঐক্যবদ্ধতা, নৈতিকমান উন্নয়ন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা। দারিদ্র্যতা দূরীকরণের জন্য সামাজিক দূরত্ব রোধ করার প্রয়োজনীয়তা এবং ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার গুরুত্ব তুলে ধরা। পরিশেষে বলবো, উলেমাগণই হলেন ইসলামের দাঈ। সমাজে ইসলাম চর্চার জন উপরিউক্ত কার্যক্রমগুলো উলেমাদেরই বাস্তবায়ন করতে হবে। আল্লাহতায়ালা তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, মোমেনশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads