• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
জাকাত ধনীর ওপর গরিবের হক

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

জাকাত ধনীর ওপর গরিবের হক

  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০২১

ইসলাম আল্লাহপ্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে জাকাত হলো তৃতীয়। ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নামাজের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি জাকাতের গুরুত্বও অপরিসীম। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের  যেসব স্থানেই নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, সেসব স্থানে জাকাত প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা সুরা মুজাম্মিলের ২৬ নং আয়াতে বলেন, ‘তোমার সালাত কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করো।’ এছাড়া পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় নামাজ কায়েমের পাশাপাশি জাকাত প্রদান করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। অথচ বর্তমানে মুসলিম সমাজে আজ জাকাতের গুরুত্ব প্রায় ভুলতে বসেছে। বর্তমানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নামাজ আদায় করেছে, রমজানে রোজা পালন করছে। পাশাপাশি ধর্মীয় বড় বড় মাহফিলের ব্যবস্থা করছে, কিন্তু জাকাত প্রদানের বেলায় উদাসীন।

জাকাত একটি আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হলো বৃদ্বি পাওয়া, পবিত্র করা, পরিশুদ্ধিকরণ ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের ভাষ্য মতে, কোনো মুসলিম নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে প্রতি বছর তার সম্পদের শতকরা ২.৫০ হারে নিদিষ্ট খাতে ব্যয় করাকে জাকাত বলে। যে পরিমাণ সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ হয়, তাকে নিসাব বলে। আর যে ব্যক্তি এই নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়,  তাকে সাহেবে নিসাব বলে। নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ কিংবা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ অর্থ। অর্থাৎ কোনো মুসলিম ব্যক্তি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ অর্থের মালিক হলে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়। আর অবশ্যই তা নিসাব পরিমাণ অর্থের ওপর পূর্ণ  এক বছর অভিবাহিত হতে হবে। নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অভিবাহিত হওয়ার আগে জাকাত ফরজ হয় না। জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, জাকাতের হিসাব হিজরি (আরবি) বছর হিসেবে করতে হবে। ইংরেজি বা বাংলা নয়। মনে করুন, আপনি এ বছর রমজান মাসে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেন তাহলে আগামী বছর রমজানে আপনার ওপর জাকাত ফরজ হবে।

জাকাত পাওয়ার যোগ্য : ইসলামী শরিয়ত অনুসারে ৮ ধরনের ব্যক্তিকে জাকাত দেওয়া যাবে। তারা হলেন- ১. ফকির। যার নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। ২. মিসকিন। যার এক বেলা খাবারও নাই। ৩. ঋণগ্রস্ত মুসলিম। ৪. অসহায় মুসাফির। ৫. জাকাত উত্তোলন-সংরক্ষণ ও বণ্টন কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ। ৬. ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক অমুসলিম, ৭) নও মুসলিম। ৮) দাস মুক্তির জন্য।

জাকাত সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। আমাদের সমাজের ধনী ও গরিব উভয়  শ্রেণির মানুষ আছে। জাকাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ধনী-গরিবের মাঝে আর্থিক সমন্বয় সাধন করার বিধান দিয়েছেন। জাকাত আদায় করলে সমাজে আর্থিকভাবে অভাবগ্রস্থ লোকেরা স্বাবলম্বী হয়। যার ফলে ধনী গরিবের মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়। প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাকাতকে ইসলামের সেতুবন্ধন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

জাকাত মানে বৃদ্ধি পাওয়া আর রমজান মাসে প্রতি ইবাদতের সাওয়াব আল্লাহ তায়ালা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। এজন্য জাকাত দেওয়ার উপযুক্ত সময় হচ্ছে রমজান মাস। জাকাত এমন একটি ইবাদত যা মানুষকে পবিত্র ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। মানুষকে মিত্যব্যয়ী হতে শেখায়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “(হে রাসূল) আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করুন। আর এর মাধ্যমে আপনি তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন।’ (সুরা তাওবা-১০৩) এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, জাকাত মানুষকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। এছাড়া জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, যা মানুষের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা মোটেই বাড়ে না। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য জাকাত দিয়ে থাক, তারাই সফলকাম।’ (সূরা রূম: ৩৯) সুতরাং এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, যারা জাকাত দেয়, তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়।

যেসব বিত্তবান লোক জাকাতের ব্যাপারে কার্পণ্য করে, তাদের ব্যাপারে আল- কোরআন ও আল-হাদিসে কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। আল- কোরআনের ভাষ্য মতে,‘যারা জাকাত আদায় করে না, তারাই আখিরাত অস্বীকার করে।’ (সুরা হা-মীম সাজদাহ-৪১) প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ব্যাপারে কঠিন শাস্তির সংবাদ দিয়ে গেছেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,”আল্লাহ যাকে ধনসম্পদ দিয়েছেন কিন্তু জাকাত আদায় করেনি। কিয়ামতের দিন তার  সম্পদকে একটি ন্যাড়া সাপে পরিণত করা হবে। তার থাকবে দুটি কালো দাগ। এই সাপে সেই ব্যক্তির গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর সাপ উক্ত ব্যক্তির গলায় ঝুলে তার দুগালে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে আমি-ই তোমার সেই সঞ্চিত সম্পদ যার জাকাত তুমি দুনিয়াতে দিতে না। অতঃপর রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা আল ইমরানের ১৮০ নং আয়াত তেলাওয়াত করলেন।’ (বুখারি, বাবু ইসমি মানিয়িয যাকাকি, হাদিস নং-১৩১৫)

জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উট এবং গরু-ছাগলের কোন মালিক যদি এগুলোর জাকাত না দেয় তবে কিয়ামতের দিন তাকে এক প্রশস্ত সমতল ভূমিতে বসান হবে। এরপর খুর বিশিষ্ট প্রাণি তাকে স্বীয় খুর দ্বারা দলিত করবে এবং শিংবিশিষ্ট পশু তাকে স্বীয় শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে। সেদিন এদের মধ্যে শিংবিহীন এবং শিং ভাঙ্গা কোনো পশু থাকবে না। আমরা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এদের হক কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, উটকে উটনীর পাল নিতে দেওয়া, এদের পাত্রসহ পানি উঠাবার জন্য কাউকে ধার দেওয়া। দুগ্ধবর্তী উষ্ট্রী অন্যকে ধার দেওয়া, পানি পান করবার স্থানে এদের দুগ্ধদোহন করা এবং আল্লাহর পথে এদের উপর লোকদেরকে আরোহণ করতে দেয়া।

যে বিত্তশালী ব্যক্তি তার তার মালের জাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন তা তার জন্য মাথার চুলপড়া বিষধর সাপে রূপান্তরিত করা হবে। অতঃপর সে সাপ জাকাত অস্বীকারকারী ব্যক্তি যেখানে যাবে সেখানেই তাকে ধাওয়া করবে। তখন সে সাপ থেকে পলায়ন করতে থাকবে। কিন্তু তাকে বলা হবে, এই তোমার সম্পদ যার ব্যাপারে তুমি কার্পণ্য করতে। অতঃপর যখন সে দেখবে এর থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই, তখন সে তার হাত এর মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে  দেবে। সে সাপ তার হাত চিবাতে থাকবে, ষাঁড়ের চিবানোর মতো। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২১৬৯)

ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এর খেলাফত আমলে কিছু মুনাফিক জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। তখন হজরত আবু বকর (রা.) বলেছিলেন, আল্লাহ শপথ! যারা নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করবে, আমি অব্যশই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। কেননা জাকাত হচ্ছে মালের হক। আল্লাহর শপথ!  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে জাকাত দিত এমন একটি উটের বাচ্চাও যদি আমার খেলাফত আমলে দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তবে অবশ্যই আমি উহা দেওয়া বন্ধ করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।’ তাহলে চিন্তা করুন, জাকাত একজন ঈমানদারের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ!

ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম একটি উৎস হচ্ছে জাকাত। জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে জীবন ও সম্পদের নিশ্চিত হয়। জাকাত যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখে। জাকাত সমাজ থেকে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে, শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। অনেকে মনে করতে পারেন, জাকাত হচ্ছে গরিবদের প্রতি ধনীদের দয়া। এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। জাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদের ওপর গরিবদের অধিকার। গরিবদের হক। আবার অনেকে মনে করতে পারে, জাকাত ধনীদের ওপর কোনো প্রকার ট্যাক্স বা জরিমানা। জাকাত কোনো ট্যাক্স বা জরিমানা নয়। জাকাত সম্পদশালীর ওপর আল্লাহপ্রদত্ত নির্ধারিত দায়িত্ব। জাকাত ইবাদত।  সুতরাং, একজন মুমিনের কখনো জাকাত প্রদানের ব্যাপারে কার্পণ্য করা উচিত নয়। সর্বোপরি, জাকাত মানুষের আত্মিক প্রশান্তি, নৈতিক উন্নতি, সম্পদের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে। তাই আমাদের সবার উচিত হিসাব করে যথাযথ জাকাত প্রদান করা।

লেখক : মো. সাইফুল মিয়া

শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,

 চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads