• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ফেরাউন : জালেমদের জন্য ভয়ানক দৃষ্টান্ত

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ফেরাউন : জালেমদের জন্য ভয়ানক দৃষ্টান্ত

  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০২১

ফেরাউন। শিক্ষা গ্রহণ করার এক ইতিহাস। যুগ যুগ ধরে আল্লাহতায়ালা বিশ্ববাসীর সামনে এই দৃষ্টান্ত বিদ্যমান রেখেছেন। বিশেষ করে জালেম শাসকদের জন্য এক ভয়ানক দৃষ্টান্ত হলো ‘ফেরাউন’।

ফেরাউন একক কোনো ব্যক্তি নয়। তৎকালীন সময়ে মিশরের বাদশাগণকে ফেরাউন বলা হতো। সেই হিসেবে প্রত্যেক বাদশা ফেরাউন। তবে আমাদের কাছে অতি পরিচিত যেই ফেরাউন বর্তমানে মিশরের জাদুঘরের সংরক্ষিত আছে এবং পবিত্র  কোরআনুল কারীমে যার বর্ণনা রয়েছে সে ছিল মিশরের জালিম বাদশা। নিজের ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা ও অহমিকায় নিজেকে খোদার আসনে আবিষ্কার করেছিল। দাম্ভিকতা ও একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার হীন চেষ্টায় একত্ববাদে বিশ্বাসীদের ওপর করা তার জুলুম-নির্যাতন, অমানবিকতা ও অসৌজন্যমূলক আচরণ তাকে বিশ্ববাসীর কাছে ঘৃণিত করে রেখেছে। তার জামানায় আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.) জামানায় পৃথিবীতে আগমন করেন। ইতিহাসের কিতাবে তার নাম কেউ কেউ রেমেসিস বলেছেন। আবার অনেকে ওলীদ ইবনে মাসআব ইবনে রাইয়ানও লিখেছেন। তার বয়স হয়েছিল চারশত বছরেরও অধিক। তার জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে নীতি নৈতিকতা, আদর্শবহির্ভূত ও আল্লাহর সাথে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে আল্লাহর ক্রোধকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। বিশেষ করে আল্লাহর নবী মুসা (আ.) ও তার অনুসারীদের প্রতি তার মাত্রাতিরিক্ত জুলুম আল্লাহর ক্রোধকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। শুধু ফেরাউন একা নয়। পৃথিবীর পাঠশালায় আমরা যা দেখতে পাই; তা হলো-আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি উদাসীন মনোভাব দেখিয়ে শয়তানের ও নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা কিংবা কোনো মুশরিকদের প্রলোভনে খোদাদ্রোহী শক্তিকে বেগবান করতে স্বজাতির ওপরে যে বা যারা নির্যাতন-নিপীড়ন, জুলুম-অত্যাচার ও হত্যায় মেতে উঠেছে, তাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ নেমে এসেছে। তারা ও তাদের সহযোগীরা ঘৃণিতভাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ্ত হয়েছে। কোনো অপশক্তি, কোনো ব্যক্তি বা কোনো জাতি গোষ্ঠী কখনো আল্লাহর একত্ববাদের আলোকে নিভিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি।

ইতিহাস অধ্যায়ন করলে আমরা দেখতে পাই, কোনো এক ব্যক্তি ফেরাউনের নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, বনী ইসরায়েলে এমন একজন সন্তান জন্ম নেবে যার হাতে তোমার রাজ্যের পতন হবে। দাম্ভিকতা, জুলুম-নির্যাতনের অবসান হবে। তোমার চাপিয়ে দেওয়া শিরকি পুঁজার পাঁজর ভেঙে আল্লাহর জমিনে আবারো একত্ববাদের ইবাদত কায়েম করবে। তার ভবিষ্যদ্বাণী শুনে ফেরাউন আরো হিংস্র হয়ে উঠলো। আত্মবিস্মৃত হয়ে আল্লাহর নিয়মকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বনী ইসরায়েল সমাজে হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করলো। অগণিত পুত্র সন্তানকে হত্যা করলো। পুরুষদের মৌলিক চাহিদা মিটাতে বাধাগ্রস্ত করলো। জুলুম-নির্যাতনের খড়গ চালিয়েও ফেরাউনের শেষ রক্ষা হলো না। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আল্লাহতায়ালা তাঁর মনোনীত ব্যক্তি প্রিয় নবী হজরত মুসা (আ.)কে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন। ফেরাউনের চোখের সামনে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয়নবীকে বড় করলেন। তাফসিরে মাআরেফুল কোরআনে আল্লামা শফি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ফেরাউনের কৌশলকে শুধু ব্যর্থ ও বিপর্যস্ত করেননি; আল্লাহ ফেরাউনের পরিষদবর্গকে চরম বোকাও বানিয়েছে। যে বালক সম্পর্কে তাদের এতো এতো ভয়। যার ভয়ে অসংখ্য পুত্র-সন্তানকে হত্যা করলো। তাঁকে আল্লাহতায়ালা এই ফেরাউনের গৃহে তারই হাতে লালিত-পালিত করলেন এবং জননীর মনস্তুষ্টির জন্য নিজ মায়ের কোলে বিস্ময়কর পন্থায় পৌঁছে দিলেন।’ আল্লাহতাআলা পবিত্র  কোরআনে সেই মনোমুগ্ধকর চিত্র মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘নিশ্চয়ই ফেরাউন তার দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীবৃন্দকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণিকে সে হীনবল করেছিল, তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত এবং নারীদেরকে সে জীবিত রাখত। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে; তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও দেশের অধিকারী করতে। আর তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ফেরাউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা তাদের নিকট থেকে তারা আশংকা করত। আমি মুসার মায়ের অন্তরে ইঙ্গিতে নির্দেশ করলাম, শিশুটিকে তুমি স্তন্য দান করতে থাক; যখন তুমি তার সম্পর্কে কোনো আশংকা করবে তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করো এবং ভয় করোনা, দুঃখ করোনা। আমি তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে  দেব এবং তাকে রাসুলদের একজন করব।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৪-৭)

উপরিউক্ত আয়াতগুলো থেকে জালিম শাসকদের জন্য রয়েছে চিন্তার খোরাক। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসীদের ওপর জুলুম, নির্যাতনের খড়গ চালানোর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা যে কোনো মূল্যে তার দীনকে বিজয়ী করবেন। কাফের-মুশরিকদের প্ররোচনায় কিংবা নিজস্ব ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে একত্ববাদে বিশ্বাসীদের ওপরে চালানো অমানবিক নির্যাতন একসময় প্রচণ্ডগতিতে নিজের দিকেই ধেয়ে আসবে। যেমনটি এসেছিল ফেরাউনের দিকে। একত্ববাদের আওয়াজকে স্তব্ধ করার লক্ষ্য হিসেবে হজরত মুসা (আ.)কে হত্যার ঘৃণ্য চক্রান্তে বসলেন ফেরাউন। ফেরাউন তার আত্মগর্ব ও দাম্ভিকতায় নিজেকে খোদার আসনে আদিষ্ট করলো। একত্ববাদে বিশ্বাসীদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো। আল্লাহতায়ালা  পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘ফেরাউন ও তার বাহিনী অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে অহংকার করেছিল যে, তারা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবেনা।’ (সুরা কাসাস, আয়াত-৩৯)

আল্লাহতায়ালা তাদের অহংকারকে ভরাডুবি দিয়ে একত্ববাদের সাফল্য বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। আল্লাহতায়ালা ফেরাউন ও তার বাহিনীকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে শাস্তি প্রদান করলেন। বিশ্বের সব জালিমদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যে, জুলুমের পতন কতটা ঘৃণিত। কোরআনের ভাষায়, ‘অতএব আমি তাকে ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং তাদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। দেখ, জালিমদের পরিণাম কি হয়ে থাকে।’ আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয়নবী ও একত্ববাদে বিশ্বাসীদের বিজয়ী করলেন। আল্লাহতায়ালা মানুষকে নেতা বানান যেন তারা তাদের নেতৃত্ব দিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। সত্য ও ন্যায়পথে মানুষকে পরিচালিত করেন। আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত নবী-রাসুল এবং মনোনীত ধর্মের প্রতি মানুষকে ডাকে। উদ্বুদ্ধ করে। সব প্রকার অনৈতিক কর্মকাণ্ড, জুলুম-নির্যাতন, শিকর-কুফুরকে নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীকে সুন্দর ও শান্তির নিবাস হিসেবে গড়ে তোলেন। কিন্তু অনেক শাসকগোষ্ঠী এর বিপরীতে গিয়ে মানুষকে একত্ববাদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহওয়ালা ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের জুলুমের মাধ্যমে আল্লাহর দীনের বিরুদ্ধাচারণ করে। আল্লাহতায়ালা তাদের উদ্দেশ্য বলেন, ‘তাদেরকে আমি নেতা করেছিলাম। তারা লোকদেরকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত। কিয়ামাত দিবসে তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এই পৃথিবীতে আমি তাদের পশ্চাতে লাগিয়ে দিয়েছি অভিসম্পাত এবং কিয়ামাত দিবসেও তারা দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’ (সুরা কাসাস, আয়াত-৪১, ৪২)

কোরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনা একথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহতায়ালার বিধানের বাইরে গিয়ে নিজস্ব কিংবা কোনো অপশক্তির শিরক-কুফর মিশ্রিত মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার ঘৃণ্য চেষ্টায় লিপ্ত হয়, তারা আল্লাহতায়ালার ক্রোধে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেই সাথে যাঁরা আল্লাহর একত্ববাদের কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন, তাদেরও বিচলিত হবার কিছু নেই। আল্লাহতায়ালা অবশ্যই রহম করবেন। যেমনটা বনী ইসরায়েলের ওপর করেছেন। অনেক পূর্বসূরিদের ওপরও এমন অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হজরত আম্বিয়া (আ.) ও তাঁদের অনুসারীদের ওপর কল্পনাতীত নির্যাতনের পরেও তারা আজ নন্দিত। বিভিন্ন অপবাদ ও অপদস্তের স্বীকার হয়েছেন। কিন্তু তারা কখনো ভেঙে পরেননি। পক্ষান্তরে জালিম তার প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করেও শেষ রক্ষা পাননি। তারা আজ নিন্দিত, অপমানিত। সাময়িক সময়ে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে আরো কাছে টানতে বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। মানুষ সত্যিকার্থে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি কিনা আল্লাহতায়ালা তা যাচাই বাছাই করেন। আল্লাহতায়ালা সুরা আনকাবুতে বলেছেন, ‘মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা?’ আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে আল্লাহর একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার তৌফিক দান করুন। আমাদের ঈমানের শক্তিকে আরো বাড়িয়ে দিন। আমিন!

 লেখক :মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার

তরুণ লেখক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads