• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
রমজানের সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

রমজানের সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা

  • প্রকাশিত ০৮ মে ২০২১

‘সাওম’ মানবসভ্যতার প্রারম্ভ হতে অদ্যাবধি চলে আসা একটি ধর্মীয় রীতি এবং ইবাদত। এটা শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যে নয় বরং এটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিদ্যমান ছিল এবং আছে। মুসলিম জাতির জন্য এই রমজানের সাওম সুসংবাদ হয়ে এসেছে। রমজানের সুসংবাদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুসংবাদ হচ্ছে পবিত্র কোরআন নাজিল করা। মূলত মানবসভ্যতার জন্য এ কোরআনের চেয়ে সবচেয়ে বড় সুসংবাদ এবং সবচেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রোজার মাস; যাতে  কোরআন নাজিল করা হয়েছে, আর এই কোরআন মানবজাতির জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী, অতএব তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটি পাবে সে রোজা রাখবে।’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-১৮৫)

কোরআন কেন মানবসভ্যতার জন্য সবচে বড় পুরস্কার; এটা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি কথা থেকে সুস্পষ্ট। বিদায় হজের ভাষণে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যারা এ দুটি আঁকড়ে ধরবে তারা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; তাহলো আল্লাহতায়ালার বাণী আল-কোরআন এবং আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ।’ মূলত এজন্যই রমজানের সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। যা কোনো মানুষ যদি আঁকড়ে ধরে, জীবন চলার পথে মেনে চলে; না সে ইহকালে লাঞ্ছিত হবে, না সে পরকালে বঞ্চিত হবে।

এই রমজানে আল্লাহতায়ালা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ একটি রাতের ঘোষণা দিয়েছেন মুসলমানদের জন্য। বিশেষ করে শেষ জামানায় বয়স স্বল্পতার কারণে বেশি করে ইবাদত করার সুযোগ নেই। এজন্য আল্লাহতায়ালা তাদের ইবাদত বহুগুণ বৃদ্ধি করার জন্য রমজানের শেষ দশকের একটি রাতকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ রাত হিসেবে ঘোষণা করেন এবং এই রাতের ইবাদতকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ঘোষণা করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি এই গ্রন্থটি নাজিল করেছি এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে। তুমি কি জানো সেই মর্যাদাপূর্ণ রাত্রি কি? মর্যাদাপূর্ণ এ রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম!’ (সুরা আল কদর, আয়াত : ১-৩) এখানে মর্যাদাপূর্ণ রাত বলতে আল্লাহতায়ালা বুঝিয়েছেন লাইলাতুল কদরকে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি কেউ লাইলাতুল কদর তালাশ করতে চায় তাহলে সে যেন রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করে। এ রাতের ইবাদত ৮৪ বছর  ইবাদতের চেয়ে উত্তম।

রমজানের একটি সুসংবাদ হচ্ছে মানবজীবনে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। মূলত তাকওয়া এবং খোদাভীতি অর্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারে। একজন মানুষ দুনিয়া এবং আখেরাতের জন্য সফলতা অর্জন করতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমনি ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-১৮৩)

রমজানের বিশেষ একটি পুরস্কার রয়েছে। এই পুরস্কারের পরিমাণটা আল্লাহতায়ালা নিজেই নির্ধারণ করবেন। অন্য সব ইবাদতের সাওয়াবের পরিমাণ নির্ধারিত কিন্তু রোজার সাওয়াবের পরিমাণ নির্ধারিত নয়। হাদিসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রোজা আমার জন্য আর আমি নিজে এর পুরস্কার দেব। অন্য বর্ণনায় আছে রোজা আমার জন্য আর আমি নিজেই এর পুরস্কার।’

হজরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ বলেন; ‘সাওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই নিজের জন্য। কিন্তু সিয়াম আমার জন্য তাই আমি এর প্রতিদান দেব। অবশ্যই সায়েম এর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের গন্ধের চাইতেও সুগন্ধি!’ (সহিহ বুখারি)

রমজানে একজন রোজাদারের জন্য আরো বিশেষ সুসংবাদ রয়েছে। তা হলো গুনাহ মাফের ঘোষণা, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ঈমানের সাথে লাইলাতুল কদরে সাওয়াবের আশায় ইবাদত করে আল্লাহতায়ালা তার পূর্বের সব  গুনাখাতা মাফ করে দেবেন এবং যদি কোনো ব্যক্তি সাওয়াবের আশায় রমজানে রোজা পালন করে আল্লাহতায়ালা তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (সহিহ বুখারি)

রোজাদারের জন্য রমজানের রোজা পালনের বিনিময় আল্লাহতায়ালা জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছেন।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য জান্নাতের রাইয়ান নামক একটি দরজা খোলা থাকবে এই দরজা দিয়ে একমাত্র রোজাদাররা প্রবেশ করবে।’ (সহিহ বুখারি)

রমজান মুসলমানদের জন্য শুধু সুসংবাদ নিয়ে এসেছে তা নয়; বরং অনেক সতর্কবার্তাও নিয়ে এসেছে। যদি মুসলমান সতর্কবার্তা গ্রহণ না করে তাহলে একদিকে যেমন রোজার সুফল থেকে বঞ্চিত হবে অন্যদিকে পরকালীন মুক্তি অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়াবে। হজরত কাব ইবনে উজরা (রা.) বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মিম্বরের কাছে একত্রিত হও। আমরা উপস্থিত হলাম। যখন তিনি মিম্বরের প্রথম স্তরে চড়লেন তখন বললেন, হে আল্লাহ কবুল করুন। তারপর যখন দ্বিতীয় স্তরে চড়লেন তখনো বললেন, হে আল্লাহ কবুল করুন। তারপর তৃতীয় স্তরে চড়ে আবারো বললেন, হে আল্লাহ কবুল করুন। খুতবা শেষে যখন মিম্বর থেকে অবতরণ করলেন, তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আজ আমরা আপনার থেকে এমন কিছু শুনলাম যা এর পূর্বে আর কখনো শুনিনি। তখন তিনি বললেন, আমার কাছে জিবরাইল (আ.) এসে বলল, যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও তাকে ক্ষমা করা হলো না, সে বঞ্চিত হোক। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ কবুল করুন। যখন দ্বিতীয় স্তরে চড়লাম তখন তিনি বললেন, যার কাছে আপনার নাম উল্লেখ করা হলো কিন্তু সে আপনার ওপর দরূদ পড়ল না, সেও বঞ্চিত হোক। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ কবুল করুন। যখন তৃতীয় স্তরে চড়লাম, তখন তিনি বললেন, যে পিতা-মাতাকে অথবা তাদের কোনো একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না সেও বঞ্চিত  হোক। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ কবুল করুন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, দ্বিতীয় খণ্ড) এই হাদিসে বঞ্চিত অর্থ কেউ কেউ করেছেন, আল্লাহর রাসুলের বদদোয়াপ্রাপ্ত। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত। যে অর্থ গ্রহণ করা হোক না কেন এটা মুসলমানদের জন্য সতর্কবার্তা।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রাখল অথচ মিথ্যা বলা এবং সে অনুযায়ী আমল বর্জন করতে পারেনি তার এই পানাহার পরিত্যাগ আল্লাহতালার কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ আল-বুখারি) অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তারা যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে যারা রোজা পালন করেনি।’ একদা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ঈদগাহ থেকে  ফিরে প্রচণ্ড রকম কান্না শুরু করলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কেন তিনি কান্না করছেন, জবাবে বললেন আমি জানিনা আল্লাহতায়ালা আমার গুনা মাফ করেছেন কিনা! উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে মুসলমানদের জন্য যেমন সুসংবাদ রয়েছে তেমনি সতর্কবার্তাও রয়েছে। আমরা আসলেই রোজার হক আদায় করে রোজা পালন করতে পেরেছি কিনা? আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করেছেন কিনা? যদি ক্ষমা না করেন, তাহলে আমরা বঞ্চিতদের দলে শামিল হয়ে যাব। অভিশপ্তদের দলে শামিল হয়ে যাবো। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। রমজান ও রোজার যথাযথ হক আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

আবু সালেহ

লেখক : প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, এস আলম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads