• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
জাকাত ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

জাকাত ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ

  • প্রকাশিত ০৮ মে ২০২১

 

 

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি হলো জাকাত। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব ফরজ বা আবশ্যকীয় ঠিক তেমনি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে প্রত্যেক মুসলিমকে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সম্পদের আড়াই শতাংশ পরিমাণ অর্থ আল্লাহর নির্দেশিত খাতে দান করতে হয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি হলো জাকাত। জাকাত অর্থ পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। প্রতি চান্দ্র বছরে অর্থাৎ ৩৫৪ দিনে একবার জাকাত দিতে হয়। জাকাত আদায় না করলে হালাল বা বৈধ সম্পদও হারাম মিশ্রিত হয়ে যায় । আর হালাল খাদ্য ব্যতীত নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি কোনো ইবাদতই কবুল হয় না। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ যেমন পবিত্র হয়, তেমনি মন ও আত্মার পরিশুদ্ধি হয়, সম্পদের প্রাচুর্যতা আসে। আর রমজান মাসে জাকাত আদায় করলে সওয়াবের পরিমাণ আরো বেশি। কেননা, এই মাসে একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি ফরজ ইবাদতের সমান আর এই মাসের একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সাওয়াবের সমান।

ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যেমন ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক সম্পদের স্বীকৃতি রয়েছে; তেমনি পুঁজিবাদকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। জাকাত গরিবের অধিকার আর আদায়কারীর জন্য নাজাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উসিলা বা মাধ্যম। আল্লাহতায়ালা জাকাত সম্পর্কে আল কোরআনে বলেন, ‘তবে তারা স্বতন্ত্র। যারা নামাজ আদায়কারী, তারা তাদের নামাজে সার্বক্ষণিক কায়েম থাকে এবং যাদের ধন-সম্পদের নির্ধারিত হক আছে যাঞ্ছাকারী ও বঞ্চিতের এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। আর যারা তাদের পালনকর্তার শাস্তি সম্পর্কে ভীত- কম্পিত।’ (সুরা- মাআরিজ, আয়াত : ২২-২৭) আবার আল্লাহ জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে বলেন ‘মুত্তাকীরা জান্নাতে ফোয়ারার নিকট থাকবে। তারা রাত্রির সামান্য অংশই নিদ্রা যেত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক ছিল।’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত : ১৫-১৯ )

আল্লাহতায়ালা যেমন জাকাত আদায়ের ফলস্বরূপ নাজাতের ঘোষণা দিয়েছেন, তেমনি জাকাত আদায় না করার শাস্তি সম্পর্কে অবগত করেছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে রাখে অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের শুনিয়ে দিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে দাগিয়ে দেওয়া হবে তাদের ললাট, পাঁজর ও তাদের পৃষ্ঠদেশ। আর বলা হবে এই সম্পদই তা , যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে সুতরাং তোমরা যা জমা করে রাখতে, তার স্বাদ গ্রহণ করো।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-৩৪ ও ৩৫) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বিষয়ে বলেন, ‘আল্লাহ যাকে সম্পদ দান করেছেন, সে যদি তার জাকাত আদায় না করে তাহলে তার সম্পত্তি কেয়ামতের দিন মারাত্মক বিষধর সর্পের আকার ধারণ করবে। তার কপালের ওপর দুটি কালো চিহ্ন কিংবা দুটি দাঁত বা দুটি শৃঙ্গ থাকবে। কিয়ামতের দিন এ সাপকে তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর সাপটি তার মুখের দুই পাশে, দুই গালের গোশত খেতে থাকবে আর বলতে থাকবে ‘আমিই তোমার মাল-সম্পদ, আমিই তোমার সঞ্চিত বিত্ত-সম্পত্তি।’ (বুখারি ও নাসায়ি)।

প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমকে জাকাত আদায় করতে হবে পরকালের শাস্তি থেকে নাজাত পেতে হলে। আর জাকাত যাদের প্রদান করতে হবে; এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘মূলত সাদকাহ (জাকাত) হলো ফকির, মিসকিন, জাকাতের কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট কর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদকারী , বিপদগ্রস্ত মুসাফির ও পথ-সন্তানের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সুরা তাওবা; আয়াত-৬০) সময়ের চাহিদা বিবেচনায় উক্ত আটটি খাতের মধ্যে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

পরিকল্পিতভাবে জাকাতের অর্থ প্রদান করলে এবং তা সঠিকভাবে বণ্টন করলে সমাজ দারিদ্র্য মুক্ত হবে। মানবিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। (ক) দারিদ্র্য বিমোচন হবে: জাকাতের অর্থ সমাজে সঠিকভাবে বণ্টন করা হলে ক্রমান্বয়ে দারিদ্র্যতার হার কমবে। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমবে। গরিব মানুষ তাদের অন্ন ও কর্মক্ষেত্রের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। (খ) শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণ : জাকাত সমাজের শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় কম। ধনীরা ধনী আর গরিবেরা আরো গরিব হয় না। এতে সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। (গ) মানবিক উন্নয়ন : জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সমাজে ধনী-গরিবের বিভেদ দূর হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও সম্প্রীতি তৈরি হয়। সমাজে অর্থের দায়ে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পায়। (ঘ) শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো : পরিকল্পিতভাবে জাকাত প্রদান করলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। জাকাত সম্পদের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ তৈরি করে। জাকাতের ফলে নগদ অর্থের মালিকানা পরিবর্তন হয় এতে প্রচুর লোক ক্রয়ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়। তখন বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হয় ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা হয় এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। সমাজে বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ যদি  কোরআন-সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাকাত প্রদান করেন এবং রাষ্ট্র যদি পরিকল্পনাভিত্তিক দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা নেয় তাহলে জাকাতব্যবস্থা সব বেকারত্ব ও অসহায়ত্ব দূর করতে সক্ষম।

বর্তমানে করোনা মহামারীর কারণে মানুষের কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় দারিদ্র্যতা বেড়েছে। তাই জাকাত করোনা মহামারীর অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিসংঘের নেতৃত্বে ‘জাতিসংঘ জাকাত তহবিল’-এর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের উদ্বাস্তুদের মধ্যে জাকাতের অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। তাই আমাদের প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমের উচিত জাকাত আদায়ে যত্নবান হওয়া।

লেখক :মো. রফিকুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, মদিনাতুল উলুম কামিল মাদরাসা, রাজশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads