• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
রোজা সামগ্রিক পরিশুদ্ধির নিয়ামক

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

রোজা সামগ্রিক পরিশুদ্ধির নিয়ামক

  • প্রকাশিত ১০ মে ২০২১

মাহে রমজান বান্দার দৈহিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির মাস। সিয়াম সাধনার মাস। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলতের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেভাবে দেওয়া হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৩) এই মুত্তাকী বা পরহেজগার শব্দটি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের পার্থক্য নিরূপণপূর্বক কেবল ভালো, ন্যায় এবং সত্যের পথে অবিচল থেকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ একনিষ্ঠভাবে পালন করার মাধ্যেই যথার্থ তাকওয়া বা পরহেজগারী নিহিত, যা মুত্তাকীর মৌলিক বৈশিষ্ট্য। বস্তুত সিয়াম সাধনা মুত্তাকী হওয়ার জন্য অন্যতম শক্তিশালী নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এক মাসব্যাপী রোজার মাধ্যমে পবিত্রতা পরিশুদ্ধতার যে কঠোর ও সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ চলে, তা যদি মানুষ একনিষ্ঠভাবে গ্রহণ, অনুশীলন ও আমল করে, তাহলে মানব মনে, মননে, চরিত্রে, ব্যবহারে এবং কাজকর্মে কুপ্রবৃত্তি, পাশবিকতা ও নেতিবাচকতার কোনো স্থান থাকতে পারে না।

লাওহে মাহফুজ থেকে অবতীর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ মানবজাতির জন্য আল্লাহর সর্বশেষ চিরন্তন, পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান আল-কোরআন অবতীর্ণের মাস মাহে রমজান। হাজার মাসের চেয়েও অধিকতর মর্যাদা ও ফজিলতের রাত লাইলাতুল কদরের মুবারক মাস মাহে রমজান। মূলত মাহে রমজান মানবজাতির হেদায়াতের ভরা মৌসুম। প্রকৃতপক্ষে রমজানের শ্রেষ্ঠত্ব, ফজিলত ও মর্যাদা, লাইলাতুল কদরের মর্যাদা ও গৌরব একমাত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের কারণে। এ মহান মাসে কোরআন যদি নাজিল না হতো, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতি হেদায়াতের সঠিক পথের সন্ধান পেত না। পেত না সিরাতুম মুস্তাকিমের সন্ধান। পেত না আল্লাহতায়ালার পরিচয় ও আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে তোলার সূত্রের সন্ধান।

মহান আল্লাহর মুহাব্বতে সিয়াম ব্রতের মাধ্যমে জীবনের সব অন্যায় আচরণ, পাশবিক প্রবৃত্তি, আল্লাহর নাফরমানি, হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, পাশবিক প্রবণতাকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে, আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মানবিক বৃত্তির বিকাশ ও উন্মেষ সাধনই তাকওয়া। মূলত ইহসান ও তাজকিরার পবিত্র বিশুদ্ধ স্তরে উপনীত হওয়াই সিয়ামের মহান শিক্ষা।

যে মুসলিম জনগোষ্ঠী সিয়ামের মাধ্যমে শুধু সুনির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত পানাহার, কামাচার হতে বিরত থাকে অথচ পরিপূর্ণ জীবনধারায় আল্লাহদ্রোহী জীবনধারা হতে বিরত থাকে না। আল্লাহদ্রোহী কুশিক্ষা, বর্বরতা, মাদকাসক্তি, ব্যভিচার, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, খুন-খারাবী, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, অসভ্যতা, এসিড নিক্ষেপ, পাশবিকতা, মানবাধিকার হরণের ঘৃণ্য পাপাচার হতে বিরত রাখে না, তাদের সিয়াম সাধনা নিছক আনুষ্ঠনিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে সিয়াম দ্বারা সিয়াম পালনকারী শুধু একমাস উপবাস ও দিনের বেলায় যৌনচার হতে বিরত থাকে, অথচ সমগ্র জিন্দেগীতে পাপাচারের গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে ভণ্ড ও বক ধার্মিক সেজে আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলে; সালাত ও সিয়াম আদায় করে কিন্তু মিথ্যা বর্জন করে না, তাদের রাত জাগা ও উপবাস থাকা ছাড়া আল্লাহর নিকট কোনো প্রতিদানই পাবে না।

আল-কোরআন শুধু সিয়ামই ফরজ করেনি। একই সাংবিধানিক ভাষায় লিখিতভাবে ফরজ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং হত্যা ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কিসাসের বিধান কায়েম করা ও আল্লাহতায়ালার পরিপূর্ণ দীন প্রতিষ্ঠা করাকেও ফরজ করা হয়েছে। কোরআনে সিয়ামকে যেমন লিপিবদ্ধভাবে ফরজ করা হয়েছে, তেমনি সালাতকে সুনির্ধারিত সময়ে লিখিতভাবে সাংবিধানিক ভাষায় ফরজ করা হয়েছে।  কোরআন শরীফে অসংখ্য আয়াতে মানবজাতিকে বিশ্বজনীন কল্যাণকর জীবন আচরণের নির্দেশনা ও নিন্দনীয় কার্যাবলিকে বর্জন করার বিধান দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের মুনকার ঘোষিত সব ব্যবস্থাপনা হতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিরত হওয়া, বিরত করা ও বিরত থাকার নামই সিয়াম সাধনা। শুধু উপহাসব্রত পালনের নামই সিয়াম-সাধনা নয়। মানবতার জন্য অকল্যাণকর সব ক্রিয়াকাণ্ড ও আচরণ থেকে বিরত থাকা, বিরত করা ও বিরত রাখার নাম সিয়াম বা রোজা। রোজা হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় রোকন বা স্তম্ভ। শব্দটি আরবী শব্দ সাওম থেকে প্রথম ফার্সি ভাষায় এবং পরে ফার্স থেকে অপরিবর্তিতভাবে বাংলা ভাষায় এসেছে। মূল আরবী শব্দ সাওমের অর্থ হচ্ছে সংযম, বিরত থাকা বা উপবাস যাপন। আর পরিভাষা হিসেবে এর অর্থ হছে, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকা। সাওম বা রোজা শুধু মুসলমানদের ওপরই নয়, পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ওপরও আল্লাহতায়ালা রোজা ফরজ করে দিয়েছেন।

কোরআন অবতীর্ণের মাস রমজানুল মুবারকে আল-কোরআনের আদেশ-নিষেধ জীবনের সবক্ষেত্রে মেনে পানাহার, ব্যভিচার, কামাচার, পাপাচার তথা মহান আল্লাহতায়ালার মর্জির বিপরীত সব নিষিদ্ধ কর্ম হতে ব্যক্তি জীবনে বিরত থাকা। নিজের পরিবারের সব সদস্যকে আল্লাহর তরফ হতে অবতীর্ণ আল-কোরআন ও আল-কোরআন জীবন বিধানের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা  কোরআনের জীবন্ত প্রতীক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নিন্দনীয় ও বর্জনীয় সব ক্রিয়াকাণ্ড থেকে বিরত রাখা। আর মুসলিম বৃহত্তম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সমাজ ও রাষ্ট্রকে আল্লাহ ও রাসুল কর্তৃক অশ্লীল ও নিষিদ্ধ সব কর্মতৎপরতা মানব রচিত আইন ও অপসংস্কৃতি হতে বিরত করার লক্ষ্যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

আল্লাহতায়ালা সিয়াম পালনের নির্দেশদানের সঙ্গে সঙ্গে সিয়ামের উদ্দেশ্য বলে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে তিনটি। ক. মুত্তাকী হওয়া, খ. হেদায়েত প্রদানের জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা, গ. তার শোকর আদায় করা। উদ্দেশ্য তিনটির মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে মুত্তাকী হওয়া। মুত্তাকী বলতে কি বুঝায়? মুত্তাকী শব্দিটি এসেছে আরবী তাকওয়া থেকে এবং যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে তিনি হচ্ছেন মুত্তাকী। তাকওয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে সংযম ও আল্লাহভীতি এবং মুত্তাকী শব্দের অর্থ হচ্ছ সংযমী, পুণ্যবান ও আল্লাহভীরু। সিয়াম বা রোজা পালনের দ্বারা মানুষ যদি সংযমী ও খোদাভীরু হতে পারে, তাহলেই সমাজে শান্তি ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। কেননা, একজন সংযমী বা আল্লাহভীরু ব্যক্তির দ্বারা সমাজে কোনো অন্যায় বা জুলুম হতে পারে না। যেহেতু আল্লাহভীরু ব্যক্তি সর্বদাই আল্লাহর নিকট পরকালে জওয়াব দেওয়ার ভয়ে ভীত থাকে। তার মনে সর্বদাই এ ভয় বিরাজ করবে যে, তিনি যদি অন্যায় করেন দুনিয়াতে রেহাই পেয়েও যান, পরকালে তিনি নিস্তার পাবেন না। সেখানে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। আল্লাহর কাছে এই জবাবদিহি ও পরকালে শাস্তির ভয়ই মানুষকে যাবতীয় অন্যায় থেকে বিরত রাখবে। মানুষ যদি এভাবে সংযমী হয়, কেউ কোনো অন্যায় অত্যাচার না করে, কারো অধিকার হরণ না করে, কারো ইজ্জত আবরুর ওপর হামলা না করে, কাউকে বে আইনিভাবে হত্যা না করে। যার যার অধিকার তাকে যথাযথভাবে প্রদান করে, তাহলেই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে মুত্তাকী হলেই শুধু এরূপ  সংযমী হওয়া সম্ভব। আবার রোজা পালন করতে হয় বছরে এক মাস এবং তা রমজান মাসে, কোরআন নাজিলের মাসে।

এ রোজা অর্থাৎ সারাদিন অনাহারে থাকাসহ সংযমী জীবনযাপনের মাধ্যমে তার মাঝে খারাপ দোষগুলো নিস্তেজ হয়ে ফেরেশতা সুলভ উত্তম গুণাবলি বিকশিত হয়। মানুষের মধ্যে এ উত্তম চরিত্রের গুণাবলি যত বেশি বিকশিত হবে, সমাজে তত বেশি শান্তি-শৃংখলা ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। রোজার মাধ্যমে মানুষের মাঝে উত্তম গুণাবলি সৃষ্টি ও সমাজে তার প্রতিপালন সম্পর্কে সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী বলেছেন, ‘দেহ ও আত্মায় মিলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ শক্তি ব্যতীত খিলাফতের এ গুরুদায়িত্ব পালন করা মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই মহা প্রজ্ঞার অধিকারী, বিশ্বজাহানের প্রতিপালক মানবজাতির আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের জন্য নাজিল করেছেন সিয়ামের বিধান। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ তার ভেতরের পাশবিক শক্তি ও ভোগবাদী মানসিকতা কিছু পরিমাণে দমন করতে সক্ষম হয়। নফস ও প্রবৃত্তির সব প্রলোভন ও প্ররোচনায় সব মুকাবিলা ও কার্যকর প্রতিরোধ সৃষ্টি করা অতি সহজ হয়। রোজার মাধ্যমে তার ইমান ও আধ্যাত্মিকতার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি অর্জন করে এবং ঝিমিয়েপড়া আত্মা পুনরুদ্ধার করে তার হূদয়ে উষ্ণতা একটু সজীবতা ছড়িয়ে দিতে পারে।

রোজাদার ব্যক্তি নিজেকে সংযত রাখা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাবশত তার থেকে ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া এবং রোজা বিনষ্টকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকা তো সহজ; কিন্তু অনর্থক কথাবার্তা ও অশ্লীল বাক্য এবং অশালীন আচরণ ইত্যাদি থেকে পুরোপুরিভাবে বিরত থাকা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় বান্দা-বান্দির জন্য সুন্দর আয়োজন করে রেখেছেন রমজান শেষে। তাহলো ‘সদকাতুল ফিতর’। এ সাদকায় ফিতরের মাধ্যমে রোজার ভুলগুলো মার্জনা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) সাদকায় ফিতর আদায় করার জন্য খুব তাকিদ দিয়েছেন, যা অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি, তা দূরীকরণ এবং নিঃস্ব লোকের আহার জোগানোর মাধ্যম। সুতরাং যে ব্যক্তি তা ঈদের আগে আদায় করে, তাহলে তা মাকবুল জাকাত হবে। আর যদি ঈদের পর আদায় করে, তাহলে তা সাধারণ সাদকা হবে। (আবু দাউদ, হাদিস নং-১৬০৯)

মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads