• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ঈদের নামাজ আদায় ও করণীয়

  • প্রকাশিত ১৩ মে ২০২১

হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় পৌঁছে দেখলেন বছরে দুটি দিন মদিনাবাসী আনন্দ-ফূর্তি করে থাকে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এ দিন দুটি কিসের? তারা বলল, আমরা জাহেলি যুগে এই দুই দিন আনন্দ-ফূর্তি করতাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য এ দুদিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন, তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ (আবু দাউদ, হদিস নং-১১৩৬) অতএব কাফিরদের ঈদে অংশ নেওয়া বৈধ নয়। কাফিরদের ঈদ-পর্বে শুভেচ্ছা জানানো মুসলমানদের জন্য জায়েজ নয়। কেননা, এর দ্বারা কুফরের নিদর্শনকে মেনে নেওয়া হয়। কাফিরদের ঈদ-পার্বনের স্থানসমূহে গমন এবং তাদের আনন্দে অংশ নেওয়া বৈধ নয়।

ঈদ ইবাদত, খুশি-আনন্দ প্রকাশ এবং বৈধ খাদ্য গ্রহণের মাঝে সমন্বয় ঘটিয়েছে। এ কারণেই ঈদ খুশি-আনন্দ ও খাওয়া দাওয়ার পর্ব। তবে ঈদের দিন এমন কোনো গর্হিত কাজ করা যাবে না, যা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের সাথে মিলে না। যেমন নারী-পুরুষের সংমিশ্রণ। নামাজ থেকে গাফেল হওয়া। হারাম পানীয় গ্রহণ করা। হারাম খেলায় মেতে উঠা এবং এজাতীয় অন্যান্য কাজ যা হারামের আওতাভুক্ত। আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন একটি নামাজ বিধিবদ্ধ করেছেন, যার নাম ঈদের নামাজ। এ নামাজটি হলো ঈদের প্রধান কাজ।

ঈদের নামাজ ওয়াজিব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন; বরং তিনি নারী, শিশু ও বৃদ্ধদেরকেও ঈদের নামাজে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ, যা উম্মে আতিয়া (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে পাই। উম্মে আতিয়া (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় নারীদেরকে বের করে নিয়ে যেতে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন: অর্থাৎ যুবতী, হায়েজগ্রস্ত ও কিশোরীদেরকে। তবে হায়েজগ্রস্তরা নামাজ থেকে বিছিন্ন থাকবে। তারা এ ভালো কর্ম ও মুসলমানদের দোয়ায় হাজির হবে।

ঈদের নামাজ আদায় পদ্ধতি : ১. ঈদের নামাজ দু রাকাত, যাতে আজান-ইকামত নেই। হজরত জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এক বার নয় দুই বার নয়; একাধিক বার ঈদের নামাজ পড়েছি তাতে আজান ও ইকামত ছিল না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১৪৭০) ঈদের নামাজের কিরাত প্রকাশ্যে পড়তে হয়। ঈদের নামাজ মসজিদে নয় বরং মাঠে পড়া সুন্নাত। বিশেষ প্রয়োজনে যদি মসজিদে পড়া হয় তবে কোনো সমস্যা হবে না। ২. প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমা, ছানাপাঠ, আউযুবিল্লাহ পাঠ ও কিরাত পড়ার পর তিন তাকবির দেবে। ৩. আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়ার পর সুরা ফাতিহা পড়ে এর সাথে অন্য একটি সুরা মিলাবে। সুন্নাত হলো সুরা ফাতিহার পর সুরা আল আ’লা পড়া। আর দ্বিতীয় রাকাতে সুরা আল গাশিয়া পড়া। অথবা প্রথম রাকাতে সুরা ক্বাফ পড়া ও দ্বিতীয় রাকাতে সুরা আল কামার পড়া। ঈদের নামাজে কেরাআত সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবি নোমান ইবনে বশির (রা.) হতে বর্ণিত, এক হাদিসে দেখা যায়, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ঈদ ও জুমার নামাজে প্রথম রাকাতে ‘সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আলা’ এবং দ্বিতীয় রাকাতে ‘হাল আতাকা হাদিসুল গাশিয়াহ’ পাঠ করতেন। (সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং-১৫৫০) সুরা ক্বাফ এবং সুরা ইক্বতারাবতিস্ সায়া পড়ার কথাও হাদিসে পাওয়া যায়। (সুনানে নাসাঈ, হাদিস নং -১৫৪৯)

৪. দ্বিতীয় রাকাতে কিরাত পড়া শেষে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে অতিরিক্ত তিন তাকবির দেবে। প্রতি তাকবিরের সাথে হাত উঠাবে। ৫. তাকবিরগুলোর মাঝে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ পড়বে। ৬. সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করার পর ইমাম মিম্বারে উঠবে। দুটি খুতবা দেবে। এ দুটির মাঝে সামান্য সময়ের জন্য বসবে। প্রথম খুতবা নয় তাকবিরের সাথে শুরু করবে। আর দ্বিতীয় খুতবা সাত তাকবিরের সাথে শুরু করবে। ঈদের নামাজে ইমাম কর্তৃক খুতবা পড়া সুন্নাত এবং মুসল্লিদের খুতবা শোনা ওয়াজিব। জুমার নামাজের ন্যায় প্রথমে বিষয়ভিত্তিক খুতবা এবং পরে সানি খুৎবা পাঠ করতে হয়। খুৎবার মাধ্যমে ঈদের নামাজের সমাপ্তি হয়। সাধারণত খুতবার পরে দোয়া করা হয়। ৭. ঈদুল ফিতরে মানুষদেরকে সদকায়ে ফিতর সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আর ঈদুল আজহায় কুরবানির হুকুম-আহকাম বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া।

ঈদের নামাজের মুস্তাহাবসমূহ : ১. ইমাম ব্যতীত অন্যান্য মুসল্লিরা সকাল সকাল ঈদগাহে আসবে এবং প্রথম কাতারের দিকে আগাবে। ২. যদি সম্ভব হয় তাহলে পায়ে হেঁটে এক পথে যাবে এবং অন্য পথে ফিরে আসবে। জাবির (রা.) বর্ণনা করে বলেন, ঈদের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাওয়া-আসার রাস্তায় পার্থক্য করতেন। (বুখারি) ৩. ঈদুল ফিতরের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বে বেজোড় সংখ্যায় খেজুর খাওয়া (তিনটি অথবা পাঁচটি)। আর ঈদুল আজহায় নামাজ থেকে ফিরে আসার পূর্বে কিছু না খাওয়া। ঈদুল ফিতরের নামাজ দেরিতে আদায় করা মুস্তাহাব। যাতে মানুষ সাদকায়ে ফিতর আদায় করতে ও হকদারদের কাছে তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে ঈদুল আজহার নামাজ সকাল-সকাল আদায় করা মুস্তাহাব।

ঈদের আহকাম : ১. ঈদগাহে, ঈদের নামাজের পূর্বে ও পরে, নফল নামাজ পড়া মাকরুহ। কিন্তু যদি ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় করা হয়, তাহলে মসজিদে প্রবেশের সময় তাহিয়াতুল মসজিদ পড়া শুদ্ধ রয়েছে। ২. যে ব্যক্তির ঈদের নামাজ পুরোটা বা অংশত ছুটে গেল তার জন্য সুন্নাত হলো ঈদের নামাজের আদায়পদ্ধতি অবলম্বন করে তা কাযা করে নেওয়া। অর্থাৎ অতিরিক্ত তাকবিরসহ দু রাকাত ঈদের নামাজ আদায় করা। যে অংশ ছুটে গেল সে অংশও ঈদের নামাজের আদায় পদ্ধতি অনুসরণ করে আদায় করে পূর্ণ করে নেওয়া। ৩. রমজান শেষে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের ওপর তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণার বিধান রেখেছেন। আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর। (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৫) ৪. উক্ত আয়াতে ‘তুকাব্বিরুল্লাহা’ এর অর্থ তোমরা যেন তোমাদের হূদয় থেকে এবং জিহ্বা দিয়ে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা করো। নিম্নবর্ণিত শব্দমালা দ্বারা ঈদের মুহূর্তে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা তথা তাকবির দিতে হয়-‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। অর্থ : আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। ৫. পুরুষদের জন্য উঁচু আওয়াজে তাকবির দেওয়া সুন্নাত। আর নারীরা দেবে গোপনে। কেননা নারীদেরকে আওয়াজ নিচু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৬. তাকবির শুরু হবে ঈদের রাতে সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদের নামাজ শুরু হওয়া পর্যন্ত। সূর্যাস্তের পর থেকে তাকবির শুরু হবে যদি পরদিন ঈদ হবে বলে সূর্যাস্তের পূর্বেই নিশ্চিত হওয়া যায়। যেমন রমজান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ হয়ে গেল অথবা ঈদের চাঁদ উঠার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল।

কিছু দিকনির্দেশনা : ১. ঈদের সময় মুসলমানদের মাঝে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় মুস্তাহাব। ২. ঈদে আনন্দিত হওয়া এবং আনন্দ প্রকাশ করা মুস্তাহাব। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও মুসলিম ভাই বেরাদরকে শুভেচ্ছা বিনিময়ও মুস্তাহাব। ৩. ঈদ একটি সুযোগ, যা আত্মীয়তা-সম্পর্ক জোড়া লাগানো এবং যাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে তাদেরকে মিলিয়ে দেওয়ার সর্বোত্তম সময়। ৪. ঈদে কবর যিয়ারত বাধ্যতামূলক নয়। আলেমদের মধ্যে  তা নিয়ে, (মতপার্থক্য) আছে।

ঈদে পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালো খাবার ও কাপড়-চোপড় ও বৈধ বিনোদনের ব্যবস্থা করা জায়েজ। ঈদ হলো খুশি-আনন্দের উপলক্ষ। আল্লাহতায়ালা আনন্দ প্রকাশকে নিষিদ্ধ করেননি। ইরশাদ হয়েছে, ‘বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। যা তারা জমা করে তা থেকে এটা উত্তম।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত-৫৮)

লেখক :গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

আলেম, গবেষক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads