• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
আল্লাহওয়ালাদের সংস্রব : গুরুত্ব ও ফজিলত

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

আল্লাহওয়ালাদের সংস্রব : গুরুত্ব ও ফজিলত

  • প্রকাশিত ২৫ মে ২০২১

মুফতি নাঈম কাসেমী

আরবীতে একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘সুহবত তথা সংস্রব পরিবর্তনশীল।’ এ জন্য দেখা যায়, মানুষ সাধারণত যার সাথে উঠাবসা করে, চলাফেরা করে, তার স্বভাব চরিত্র ওই ব্যক্তির মতো হয়ে যায়। সৎ ও ভালো মানুষের সংস্রব অনেক দামি ও মূল্যবান। দুনিয়াতে একজন মানুষ যার সাথে সম্পর্ক রাখবে তার সাথেই তার হাশর হবে। এ জন্য আমাদের সম্পর্ক যদি আল্লাহর নেক বান্দাদের সাথে থাকে তাহলে আমাদের হাশরও তাদের সাথেই হবে বলে আশা করা যায়। মানবসমাজে জ্ঞানী-সচ্চরিত্রবান এবং খোদাভীরু ব্যক্তিকেই সাধারণত সৎ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমন আদর্শ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকের সংসর্গ লাভ করা বাস্তবিকই সৌভাগ্যের পরিচায়ক। কেননা সৎ ও সুধীজনের সংসর্গে মানুষ ধন্য হয় এবং তাঁর থেকে উত্তম চরিত্র, উন্নত মানের শিক্ষা আর সদুপদেশ লাভে উপকৃত হয় ও স্বীয় সৎ-জিন্দেগী গঠনে ব্রতী হয়। কেননা, মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা মানুষের মধ্যে তাঁর কুদরতে এরূপ অনুকরণ-অনুসরণ জ্ঞান দান করেছেন, যা দ্বারা সে যা দেখে ও যা শুনে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। তবে এক্ষেত্রেও বিবেকবান মানুষকে তার বুদ্ধি-বিবেচনা এবং সম্যক জ্ঞান খাটিয়ে সত্য-অসত্য, ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভ এবং মঙ্গল-অমঙ্গলের তারতম্য করে সৎ ও জ্ঞানীজন থেকেই তার কল্যাণমুখী জ্ঞান ও শিক্ষা গ্রহণ করবে।

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! (চলা-ফেরা ও সব কাজে) তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং (যারা দীন ধর্মের ব্যাপারে অটল এরূপ) সত্যবাদীদের সংসর্গ গ্রহণ কর।’ (সুরা তাওবাহ) এখানে সত্যবাদীদের সংগে থাকা এবং সত্যবাদীদের সংসর্গ গ্রহণ করার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা সত্যবাদীদের সাহচর্য এবং তাদের অনুরূপ আমলের মাধ্যমে তাকওয়া (খোদাভীতি) অর্জন করো। পক্ষান্তরে মিথ্যাবাদী ও নাফরমানদের সাহচর্য ত্যাগ করার প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোরআন মাজীদে সত্যবাদীদের দ্বারা মূলত আলেম ও সৎকর্মশীলদের প্রকৃত পরিচয়ই দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহতায়ালা জনসাধারণকে সত্যবাদীদের তথা আলেমদের সংশ্রবের ওপর জোর দিয়েছেন। এর দ্বারা সচ্চরিত্র, সৎজ্ঞান এবং সৎ-কার্যকলাপের শিক্ষান্বেষীদেরকে একান্ত জোরালোভাবেই নির্দেশ প্রদান করত দীনি সত্য-জ্ঞান শিক্ষার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘তোমরা যাদের সংসর্গ গ্রহণ কর এদের মধ্যে সৎ ও উত্তম ওই ব্যক্তি; যাকে দেখামাত্র আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। যার কথাবার্তা ও উপদেশসমূহে তোমাদের জন্য ইলমে দীন (ধর্মীয় জ্ঞান) শিক্ষার সম্পূরক ও পরিবর্ধক হয় এবং যার আমল ও কার্যকলাপ তোমাদের পরকাল স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (আবু ইয়ালা) হজরত লুকমান হাকীম স্বীয় পুত্রকে বলেছিলেন, বৎস! তুমি আলেম-উলামা ও সত্যিকার জ্ঞানীদের সংসর্গ গ্রহণ করো। কেননা, এদের (জ্ঞানীদের) থেকে তুমি প্রকৃত জ্ঞানের কথা জানতে পারবে ও শিখতে পারবে। ফলে বৃষ্টির মুষলধার পানিতে যেরূপ মৃতপ্রায় শুষ্ক জমিন তরতাজা হয়ে উর্বরশক্তি লাভ করে, তদ্রূপ জ্ঞানীদের সংসর্গলাভে তোমার অন্তরেও প্রকৃত জ্ঞানের আলো সৃষ্টি হবে। (তাবরানী)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘ওই ব্যক্তির জন্য আমার মুহাব্বত একান্ত জরুরি হয়ে পড়বে যারা সততার সাথে নিঃস্বার্থভাবে পরস্পর মায়া-মুহাব্বত স্থাপন করে এবং সত্য ও সঠিক জ্ঞানাহরণের উদ্দেশ্যে যারা একে অন্যের সাথে উঠাবসা করে।’ (মুয়াত্তা মালেক ও ইবনে হাব্বান) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের এমন উপদেশ দিচ্ছি যা দীন শিক্ষার পথে একান্ত সহায়ক। যা দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতে তোমরা উপকৃত হতে পার। আর তা এই যে, তোমরা আহলে ইলম বা সত্যিকার জ্ঞানীদের সংসর্গ গ্রহণ করো। দ্বিতীয়ত: একাকী থাকলে আল্লাহ স্মরণ থেকে উদাসীন থেকনা এবং তৃতীয় কথা হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে (মুমিনদের সাথে) মুহাব্বত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে (কাফির-মুশরিকদের সাথে) শত্রুতা পোষণ কর।’ (বাইহাকী)।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রকৃত আলেম ও সঠিক ঈমানদারদের ব্যতীত অন্য কারো সংসর্গ গ্রহণ করো না।’ (জামে তিরমিযি, আবু দাউদ ও দারেমী) পক্ষান্তরে আল্লাহর নবী এটাও বলেছেন যে, তোমরা (কথায়, কাজে ও আমল-আকায়েদে) আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব স্থাপনকারী মুশরিকীনদের সংসর্গে যেয়ো না এবং তাদের সংশ্রবে থেক না, এমনকি তাদের মিল-মজলিশে যেয়ে বসনা। কেননা, যে তাদের সংসর্গ গ্রহণ করলো (মনে করে নিও) সে তাদেরই একজন।’ (জামে তিরমিযী) মশহুর সাহাবি ও ইমামুল ফুক্বাহা হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘যারা নিজেদেরকে সর্বদা জ্ঞানপূর্ণ সততার সাথে চলতে আগ্রহী মনে করে, তারা যেন যারা এজগৎ ছেড়ে গেছেন এরূপ জ্ঞানীদের কথা স্মরণ করে এবং তাঁদের আদর্শ চরিত্র ও নেক আমলের অনুসরণ করে। কেননা, এসব ব্যাপারে জীবিতদের পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা থাকতে পারে, কিন্তু চরিত্রবান ও আমলদার মৃত ব্যক্তিদের তা অসম্ভব। বিশেষত: সত্যের মানদণ্ড হিসেবে বিনা দ্বিধায় যাঁদের অনুসরণ আজীবনের মহাদর্শ ও গ্রহণযোগ্য, তাঁরা হচ্ছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবায়ে কিরাম (রা.)। আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাদের পরও যাদের আমল আখলাক এবং স্বভাব-চরিত্র খাঁটি ও নির্ভেজাল, এমন ব্যক্তির সংসর্গ ও সাহচর্য গ্রহণ করো।’ (জামউল ফাওয়ায়েদ)

অপরাধী যেমন ক্ষমাপ্রাপ্তির আশা নিয়ে যায় উদার ও মহৎ ব্যক্তির নিকট এবং ক্ষুধার্ত-অসহায় ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিগণ যায় বিত্তশালী ধনীদের নিকট এবং সাহায্য-সহায়তা লাভ করে। তেমনিভাবেই সর্বসাধারণ মানুষের জন্যও প্রকৃত জ্ঞানীদের সংসর্গ লাভে তাদের থেকে জ্ঞান ও উপদেশ লাভে নিজেদেরকে ধন্য হবার সুযোগ মিলে। ফলে মানুষ সৎসংগ লাভে সৎ ও জ্ঞানীতে পরিণত হয়। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘সৎ-সংসর্গ লাভে সৎ হয় লোক, অসতের সংগীদের আজীবন দুখ। সৎ আর সাধুতার মহৎ গুণেতে, মানুষ ফেরেশতা হতে শ্রেষ্ঠ এ জগতে।’

সচ্চরিত্র ও সৎ-স্বভাব মানুষের অমূল্য সম্পদ এবং উন্নত আদর্শের চাবিকাঠি। তাই এর ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেবল সৎ-স্বভাবকে দাড়ির এক পাল্লায় স্থাপন করে মানুষের গুণগত অন্যান্য সমুদয় বস্তু অপর এক পাল্লায় স্থাপন করলে সৎ-স্বভাবই অধিক ভারী হবে। এক ব্যক্তির প্রশ্ন ছিল, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ধর্ম কি বস্তু? এর জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সৎ-স্বভাব। অপর এক ব্যক্তির প্রশ্ন ছিল, কোন বস্তু সর্বোত্তম? এর জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সৎ-স্বভাব। অনুরূপ আর এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সৎকর্ম করবে। আর প্রফুল্লতা ও সৎ-স্বভাবের মানুষের সাথে মেলামেশা করবে।

একদা কতিপয় লোক সম্যক অবগতি লাভ ও জানার উদ্দেশ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, আল্লাহতায়ালা মানুষকে যা দান করেছেন তন্মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট কি? এর জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন সৎ-স্বভাব। কেননা, বরফ যেমন সূর্যের উত্তাপে গলে যায়, ঠিক তেমনিভাবে সৎ-স্বভাবও মানুষের দোষত্রুটি এবং পাপসমূহ নষ্ট করে ফেলে। জেনে রাখো! মানুষের পুণ্যকর্ম (নেক আমল) এবং ঈমানদারির সাথে সৎ-স্বভাব তাকে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত করে দেয়। আর এ দুনিয়াতে সৎ-স্বভাবের দ্বারাই মানুষ সা-য়িমুদ্দাহার ও ক্বা-য়িমুল্ লাইল (দিনে রোজা পালন এবং সারা রাত্র  আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী) এর মর্যাদা লাভ করতে পারে।

আর এক সময় কতিপয় লোক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে আরজ করলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! অমুক স্ত্রীলোক নামাজ-রোজাতে খুবই পাবন্দ, কিন্তু তার স্বভাব-মেজাজ এত খারাপ যে, সে নিতান্ত অশ্লীল ও কর্কশ বাক্যে প্রতিবেশীদেরকে অহরহ কষ্ট দিচ্ছে। এতদশ্রবণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই মহিলার স্থান হবে জাহান্নামে। পরন্তু আল্লাহর রাসুল এ ব্যাপারে আরো বলেছেন, জেনে রাখো! সিরকা যেমন মধুকে বিনষ্ট করে, কু-স্বভাব এবং বদ-মেজাজও মানুষের ইবাদত-বন্দেগীকে বিনষ্ট করে ফেলে। (কিমিয়ায়ে সাআদাত)

এক হাদিসে পাকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন ওই সব মানুষ আমার অনেক নিকটে থাকবে যাদের চরিত্র অনেক উত্তম।’ তাই আমরা যদি চাই আমাদের হাশর হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হোক, তাহলে আমাদের উত্তম চরিত্রবান ও সৎ হতে হবে এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে। এখানে একটা বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু সম্পর্ক রাখলেই হ েবনা বরং আল্লাহর নেক বান্দাদের মতো আমলও করতে হবে। নিজের চরিত্র তাদের মতো সাজাতে হবে। নবীর সুন্নতের রং দিয়ে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে হবে। তাহলেই আল্লাহর হাবীব হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমাদের হাশর হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads